ভয়াবহ ভূমিকম্প, বিধ্বস্ত নেপাল
ভয়াবহ ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে নেপালে। দেশটির বেশির ভাগ স্থান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল শনিবার সকালে সংঘটিত এই ভূমিকম্পের মাত্রা ধরা পড়ে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮। আহতের সংখ্যা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পর্বতারোহণের এই ভরা মৌসুমে ভূমিকম্পের প্রভাবে তুষারধসে এভারেস্টের বেইস ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। এতে অন্তত ১৫ পর্বতারোহী প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। দেশটিতে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের আঁচড় পড়েছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীনেও। ভারতে ৪১ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। বাংলাদেশে দুই দফা ভূমিকম্পে চারজনের মৃত্যুর পাশাপাশি ১৭৭টি ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং কিছু ভবন হেলে পড়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে সারা দেশেই।
ভূমিকম্পে নেপালে কোনো বাংলাদেশি হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার বাড়ির দেয়াল ধসে পড়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানায়। এদিকে জরুরি যোগাযোগের জন্য নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসে হেল্প ডেস্ক চালু করা হয়েছে। হেল্প ডেস্কের নম্বরগুলো হলো : রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস (+৯৭৭৯৮৫১০৩৯৩৫২), প্রথম সচিব খান মো. মইনুল হোসেন (+৯৭৭৯৮০৮১৮৪০১৪) ও প্রথম সচিব শামীমা চৌধুরী (+৯৭৭৯৮০৮৭৬৫০৭১)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, নেপালে উৎপন্ন হওয়া ভূমিকম্পের তীব্রতা বাংলাদেশে অনুভূত হয়েছে ৪ থেকে ৫-এর মধ্যে। ভূমিকম্পকালে তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি ও সূত্র ব্যবহার করে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত মজবুত স্থাপনায় তীব্রতার মাত্রা অনুভূত হয়েছে ৪ এবং অপেক্ষাকৃত নরম মাটি বা স্থাপনায় তীব্রতা ছিল ৫।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে জানায়, ভূমিকম্পের উৎস ছিল নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দূরে লামজুং-এ। ভূমিকম্পের আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঠমাণ্ডু। সংস্থাটি আরো জানায়, দুপুর পর্যন্ত আরো ১২টি ভূমিকম্প-পরবর্তী ভূকম্পন হয় বলে তারা রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে একটির মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল রাতেও ভূকম্পন টের পাচ্ছিল তারা।
নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লক্ষ্মী প্রসাদ ধাকাল বলেন, এ ভূমিকম্পে আহত হয়েছে কয়েক হাজার। গত ৮১ বছরের মধ্যে এটাই নেপালের ভয়াবহতম ভূমিকম্প। এর আগে ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে নেপালে ১০ হাজার ৭০০ লোক নিহত হয়। দেশটির অর্থমন্ত্রী রাম শরণ মাহাত গত রাতে এক টুইটার বার্তায় জানান, শনিবারের ভূমিকম্পে তাঁর দেশে ১ হাজার ৪৫৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
উদ্ধারকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরু করলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে অনেককে খালি হাতে ধ্বংসাবশেষ সরাতে দেখা গেছে। নেপালের জাতীয় পুলিশের মুখপাত্র কামাল সিং বাম বলেন, দূর পশ্চিম ছাড়া বাকি সব এলাকা থেকেই হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। উদ্ধার ও সহায়তার জন্য নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।
নেপালের তথ্যমন্ত্রী মীনেন্দ্র রিজাল বিপর্যয় মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই ফ্রান্স নেপালকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ফাঁসোয়া ওলন্দ গতকাল এ কথা জানান।
ভূমিকম্পে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া কাঠমাণ্ডুর দরবার স্কয়ার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। ১৮৩২ সালে নির্মিত কাঠমাণ্ডু ধারাহারা মিনারও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সে সময় নজরদারির জন্য রানির নির্দেশে ৯ তলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর আট তলার একটি বেলকোনি থেকে পুরো কাঠমাণ্ডু দেখা যেত। এই ভবনের ধ্বংসস্তূপে বহু পর্যটক আটকা পড়েছে। গতকাল বিকেলেই এর ধ্বংসাবশেষ থেকে ১২টি মৃতদেহ বের করা হয়। মিনারের নিচে চাপা পড়া বার্তা সংস্থা এএফপির আলোকচিত্রী ধার্মু সুবেদি (৩৬) বলেন, ‘চাপা পড়ার পর নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। তবে ধীরে ধীরে ইটের স্তূপ সরিয়ে ফেলি আমি। পরে আমাকে কেউ একজন টেনে তোলে।’ এরপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে বহু বাড়ি ভেঙে পড়েছে। অনেক রাস্তায়ই গভীর ফাটল দেখা গেছে। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর লোকজন ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে।
ভূমিকম্পের কারণে কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের এই একটি মাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতেও ফাটল ধরেছে।
নেপালের এই ভূমিকম্পের ধাক্কায় কেঁপে ওঠে ভারতের বহু এলাকা। সে দেশে ৪১ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বিহার রাজ্যে ১৭ জন প্রাণ হারায়। বহু বাড়িঘর ধসে গেছে। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত লোকজন বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে।
ডেস্ক রিপোর্ট – ঢাকা বিডি ২৪