সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন আশরাফুল
ফিক্সিং বিতর্ক নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশে। কিন্তু আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) পরামর্শে বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহাম্মদ আশরাফুল ছিলেন নিশ্চুপ। অবশেষে মুখ খুললেন তিনিও। কাল ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক।
গতকাল দুপুরে বোর্ড সভা শেষে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান জানিয়ে দেন, আকসুর কাছে ম্যাচ পাতানোর কথা স্বীকার করেছেন আশরাফুল, স্বীকার করেছেন তাঁর কাছেও। এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আশরাফুলের বনশ্রীর বাসায় সাংবাদিক আর টেলিভিশন ক্যামেরার ভিড়। সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও একটা স্রোত ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। বোর্ড সভাপতি যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবেই বলে দিয়েছেন আশরাফুলের স্বীকারোক্তির কথা, এবার নিশ্চয়ই আশরাফুলও মুখ খুলবেন। কিন্তু আকসুর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আশরাফুল কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন তাঁর বাবা। সাংবাদিকদের বারবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত যে আশরাফুল নিচে নেমে এলেন, তাঁকে চেনা কঠিন। গত কয়েক দিনের মানসিক ঝড় আর হতাশায় অন্ধকার হয়ে থাকা চেহারাটা দাড়িগোঁফে আরও মলিন।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে আকসুর নিষেধাজ্ঞা থাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে আকসু ও বিসিবির অনুমতি নিয়েছেন আশরাফুল। বিসিবি সূত্র জানিয়েছে, সাংবাদিকেরা কথা বলতে চাইলে আকসুর এক কর্মকর্তার সঙ্গে আশরাফুল টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে কৃত অপরাধের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান ওই কর্মকর্তাকে। তাঁর সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন আশরাফুল। সব অপরাধ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চান টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান, ‘শুধু একটা কথাই বলব। আমাকে সবাই ক্ষমা করে দিয়েন। যে অন্যায় কাজগুলো করেছি…এখন ক্রিকেটের ভালোর জন্যই সব সত্য কথা বলেছি।’ আশরাফুলের উপলব্ধি, ‘এভাবে অন্যায় করাটা ঠিক হয়নি। জাতির সঙ্গে এবং আমার নিজের সঙ্গেও। আমি নিজেও অপরাধবোধে ভুগছি ওই জিনিসগুলোর জন্য। এ জন্যই মনের ভেতর যত অপরাধ ছিল, সব আইসিসির কাছে ক্লিয়ার করতে চেয়েছি।’
আকসু কর্মকর্তাদের কাছে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিকের চাপে বিপিএলে ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ের কথা তো আশরাফুল স্বীকার করেছেনই, বিবেকের তাড়নায় খুলে বলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার ঘটনা। কারা তাঁকে প্রথম এই অন্ধকার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে জড়িয়েছেন ফিক্সিংয়ের সঙ্গে—খুলে বলেছেন সবই, ‘বারো বছরের ক্যারিয়ারে আমাকে এই প্রথম আকসু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আকসুর কাছে প্রথমবারেই আমি সব সত্য কথা বলেছি। ওরা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, আমার মনে হয়েছে আমি কিছু অন্যায় কাজ করেছি। ওগুলোই বলার চেষ্টা করেছি। আমি আইসিসিকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছি।’
তদন্ত প্রতিবেদন আসার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আশরাফুল। তবে তিনি যে এ বিষয়েও আকসুকে অনেক কিছুই জানিয়েছেন, আশরাফুলের কথায় আভাস আছে সেটারও, ‘সবই ওখানে বলা হয়েছে। আমার ক্যারিয়ারে, আমার জীবনে অন্যায় কাজ যতগুলো করেছি সবকিছুই ওখানে বলা হয়েছে।’ আশরাফুলের দাবি, আকসুর কাছে ম্যাচ ধরে ধরেই বর্ণনা করেছেন সবকিছু, ‘আমি সবই আইসিসিকে বলেছি। প্রত্যেকটা ম্যাচ…বারো বছরের ক্যারিয়ারের সবকিছু আমি ওদের বলেছি। একটা কথাও মিথ্যা বলা হয়নি ওখানে। সবগুলো সত্য কথা বলা হয়েছে। আপনারা সবাই আমাকে চেনেন, আমি কেমন। বারো বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি। আমি কেমন মানুষ, আপনারা জানেন। একটাও মিথ্যা কথা বলা হয়নি।’
বিভিন্ন সময়ে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিলেও আশরাফুলের দাবি, ‘আমি বারো বছরে আড়াই শটা (২৬১) ম্যাচ খেলেছি ওয়ানডে, টেস্ট, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে। সব সময়ই চেষ্টা করেছি সেরাটা দেওয়ার।’ সঙ্গে বলেছেন, জাতীয় দলের আর কেউই তাঁর ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা জানতেন না।
বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসই তাঁকে ফিক্সিংয়ে বাধ্য করেছে বলে আকসুকে জানিয়েছেন আশরাফুল। আর ২০০৪ সালে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ফিক্সিংয়ে জড়ান, বয়সটা অনেক কিছু না বোঝার মতোই ছিল। সাংবাদিকদের তাই কৌতূহল, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়লেন নিষিদ্ধ জগতের সঙ্গে? আশরাফুল আপাতত সেই কৌতূহল মেটালেন না, ‘ওই পরিস্থিতিটা আসলে এখন বোঝানো যাবে না আপনাদের। যে পরিস্থিতিতে খারাপ কাজগুলো আমি করেছি, ওই পরিস্থিতি বোঝাতে পারব না। যারা এই পরিস্থিতিতে পড়বে ওরাই বুঝবে।’
আশরাফুলের যন্ত্রণা এখনো আশরাফুলই সবচেয়ে ভালো বুঝছেন। বিসিবি আপাতত তাঁকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও ধরে নেওয়া যায়, দীর্ঘ মেয়াদেই ক্রিকেটের বাইরে চলে যাচ্ছেন অসামান্য প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা এই ব্যাটসম্যান। আশা একটাই—আকসুর সামনে যেহেতু নিজ থেকেই খুলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্ধকার একটা কুঠুরি, ক্রিকেট শুদ্ধিকরণে তাঁর এই সাহায্যের কথা মনে রাখবে আইসিসি। সেটা না হলে হয়তো এখানেই শেষ বাংলাদেশের ক্রিকেটে মোহাম্মদ আশরাফুল অধ্যায়।