যৌন কৌতূহল অপরিণত বয়সে
আপনার বাচ্চার বয়স নিতান্তই কম। সে আপনার কাছে জানতে চাইছে, ‘ মা, ঋতুচক্রের ব্যাপারটা আসলে কী?’ এটা হয়তো আপনি কখনো ভাবতে পারেননি। তবু আপনাকে ভাবতে হবে। কারণ সন্তানের এসব প্রশ্নের উত্তর আপনি ‘আন্তরিকতা’র সঙ্গে এড়িয়ে গেলে বরং আপনারই ক্ষতি। সেই সঙ্গে আপনার ছেলে মেয়ের। তাই এ বিষয়ে আপনাকে সচেতন হতে হবে এখনই।
এসব বিষয়ে আপনার অপ্রাপ্ত কিংবা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের জানাতে হলে, বুঝাতে হলে আপনাকে জানতে হবে ‘সেক্স এডুকেশন’। বাংলায় বিজ্ঞানসম্মত যৌন-শিক্ষা। এই শিক্ষার সবচেয়ে সুন্দর আর আদর্শ নাম হতে পারে ‘ফ্যামিলি লাইফ এডুকেশন’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই নামটাই চলে। বাংলায় বলা যায় ‘পারিবারিক জীবনের শিক্ষা’।
না, কোনো সংকোচ নয়। এটা বাজারে বিক্রির গাল-গল্পের বই নয়। আপনার নিজের প্রয়োজনেই আপনাকে বুঝে নিতে বলা হচ্ছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যৌনতার বিজ্ঞান আর মনস্তত্ত্বকে। জানতে হবে মানব-প্রজননের বিজ্ঞানকে, এর মূল সূত্রগুলোকে। জেনে বুঝে নিতে হবে যৌবনের শুরু আর শেষ, এই দুই প্রান্তিক সময়কালের পরিবর্তন আর সমস্যাগুলোকে।
বাচ্চার প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে শিখুন। মাঝে-মধ্যে বাচ্চারা জন্মরহস্য নিয়ে নানা প্রশ্ন করবেই। ওদের চুপ করিয়ে দেবেন না বা অন্য কথায় ভোলাতে যাবেন না। এরকম প্রশ্নের উত্তর হবে বিজ্ঞানসম্মত অথচ বাস্তবমুখী। ঘাবড়াবেন না, ফিসফিস করে বলবেন না, ছেলেমেয়ের এরকম প্রশ্নের উত্তর দিন সহজ-সরলভাভাবে, গল্পের ছলে। বাচ্চা যেন না ভাবে ব্যাপারটায় আপনি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন বা কিছু লুকচ্ছেন।
‘আগে বড় হও, পরে সব জানতে পারবে’ বা ‘এ সব জানার জন্য তুমি এখনও খুব ছোট’-এরকম দায়সারা উত্তর বাচ্চার পক্ষে ক্ষতিকর। উত্তরটা কীভাবে দেবেন জানা না থাকলে বাচ্চাকে বলুন, ‘বা! বেশ ভালো প্রশ্ন করেছ তুমি। এর উত্তরটা তোমাকে কীভাবে সহজে বোঝানো যাবে তা নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও।’ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে পরে বাচ্চাকে সহজ করে বুঝিয়ে দিন।
‘না’ দিয়ে বলবেন না নর-নারীর সম্পর্ক বা জন্মরহস্য নিয়ে বাচ্চার প্রশ্নের মুখোমুখি আপনার উত্তর হবে আবশ্যিকভাবে সদর্থক। বাচ্চা অশ্লীল কথা বললে, ‘এরকম কথা আর ভুলেও বলবে না’ বলে বাচ্চাকে বকা দিলে ব্যাপারটাকে নিষিদ্ধ ভেবে এর প্রতি ওর আকর্ষণ আরও বাড়বে।
যৌন-শিক্ষার বিজ্ঞান বলে, বাচ্চাকে নরম করে বলুন, ‘এরকম কথা বললে আমি খুব কষ্ট পাই। আমি কষ্ট পাই তা কি তুমি চাও? এই কথাগুলো বলতে পারেন নিজের মতো করেও।
বাচ্চাদের প্রশ্নের দুটি আদর্শ উত্তর হতে পারে এরকম-
‘মা আমি কি করে হলাম?’: তুমি হয়েছ আমার আর তোমার বাবার ভালোবাসা থেকে। আমরা দু’জনে ভালোবেসে তোমায় চাইলাম, তাই তো তুমি হলে সোনা!
‘মায়ের পেট থেকে বাচ্চা কিভাবে বেরোয়?’: মায়ের পেটের ভেতর একটা থলির মধ্যে বাচ্চা আস্তে আস্তে বড় হয়। তারপর অনেকটা বড় হয়ে জন্মের একটা রাস্তা আছে, সেই রাস্তা দিয়ে বাচ্চা মায়ের শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ঠিক যেভাবে স্কুল ছুটি হয়ে তুমি ক্লাসের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আস।
বাচ্চার ব্যাপারে যা করবেন না: টিভি বা ভিডিওর মারামারি, ধর্ষণের চেষ্টা বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ছবি বাচ্চাকে গিলতে দেবেন না। আপনি সচেতন হলেই পারবেন। যৌন রসিকতা বা গল্প বাচ্চার সামনে ভুলেও নয়।
একটু বড় বাচ্চার সামনে বা বাচ্চাকে কাছাকাছি রেখে শরীরী ঘনিষ্ঠতার দিকে এগোবেন না।
সম্ভব হলে সাত-আট বছরের পর থেকে বাচ্চাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বিছানায় শোয়াবেন না। বিকল্প হিসেবে, দাদা বা দাদীর সঙ্গে বা আলাদা বিছানায় বাচ্চাকে ঘুমাতে অভ্যস্ত করে তুলেন।
যৌনাঙ্গ নিয়ে খেলা করছে বাচ্চা, নজরে এলো আপনার। ভুলেও বাচ্চাকে বকবেন না বা মারধর করতে যাবেন না। ওকে বুঝিয়ে বলুন নরম করে। বলুন, ‘এই নরম জায়গা নিয়ে খেলা করলে যে তুমি ব্যথা পাবে, কষ্ট পাবে। আর তুমি কষ্ট পেলে সব চাইতে বেশি কষ্ট পাব আমি।
যৌনতা বিষয়ক বাচ্চার কোনো আকস্মিক প্রশ্ন চেপে দিতে যাবেন না। গল্পচ্ছলে উত্তর দিন। না জানলে জেনে নিয়ে পরে বলুন।
ছেলে বা মেয়েকে কম বয়স থেকে বিকৃতকাম পরিণত বয়স্ক পুরুষ বা নারীর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ার ব্যাপারে সাবধান করতে ভুলবেন না। এরকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার শিকার হয়ে অনেক ছেলে মেয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে নানা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। সচেতন হন, সতর্ক থাকুন।
টিনএজের ছেলেমেয়ের বাবা-মায়েরা শিখুন বয়ঃসন্ধি সব ছেলে মেয়ের জীবনেই এক ধরনের পরীক্ষা। শরীর-মনে দ্রুতলয়ে ঘটতে থাকা পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে এই সময় ছেলে মেয়েরা শরীর মনে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়। ওদের এই বিশেষ সমস্যাগুলোকে জেনে বুঝে নিন, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ওদের পাশে থাকুন বন্ধুর মতো। ওদের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলোকে এড়িয়ে যাবেন না, সহানুভূতির সঙ্গে ওদের সমস্যাগুলো বুঝুন। ওদের সঙ্গে আলোচনা করুন খোলাখুলি, বন্ধুর ভূমিকা নিন। ছেলেদের সমস্যায় বাবা আর মেয়েদের সমস্যায় মা হতে পারেন আদর্শ শিক্ষক ।
জীবনে চলার পথে যে ‘যৌনতা’ অমোঘ সত্য, তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আর যদি তা করার চেষ্টা করেন, তাহলে ক্ষতি হবে আপনার নতুন-প্রজন্মেরই। আপনার ছেলে-মেয়েদের মন বুঝার চেষ্টা করুন। বেশি বেশি সময় দিন। তাদের ভালো দিকগুলো খোজার চেষ্টা করুন।