Published On: Sat, Jun 22nd, 2013

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যার নাম লেখা হয়নি !

Share This
Tags

small_profile-banner-shadow-womanরিজওয়ান করিম : লালজান বেওয়া, বয়সের ভারে ন্যূব্জ নিভৃত পল্লীবাসী মহিলা যার নাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো কোনদিন লেখা হবে না। কিন্তু তার গভীর মাতৃস্নেহ ও প্রত্যুৎপন্নমতিতা শেরপুরের সীমান্তবর্তী রামচন্দ্রকুড়া গ্রামের ছামেদ আলীর ছেলে নূর মোহম্মদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া দলছুট মুক্তযোদ্ধাদের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন।
১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন ছিল পহেলা রমজান। ৬০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কোম্পানী কমান্ডার রফিজউদ্দিন রেফাজের নেতৃত্বে ৮১ সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভারত সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বুড়ি ভোগাই নদী পেড়িয়ে ঘন ছন আর ঝোপ-জঙ্গলে ভরা বনাঞ্চলের সরু পথে অগ্রসর হচ্ছিল। উদ্দেশ্য ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় গিয়ে অপারেশন চালানো। কিন্তু হঠাৎ পথে পাক বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়ে শাসছুল হক নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আর মাইন বিস্ফোরনের শব্দে ওৎ পেতে থাকা পাক বাহিনী বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রাণ ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা দলটি। পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক। আহত মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপরেও ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া দলটি সংগঠিত হয়ে আক্রমনের চেষ্টা করে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনীর গুলি বর্ষনের মুখে তাদের প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। এসময় গুলিতে ৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তারা হচ্ছেন মির্জা আব্দুল খালেক, আব্দুস সাত্তার, নূরুল ইসলাম, হাতেম আলী, বাবর আলী ও অজ্ঞাত নামা আরো দু’জন। এদের সবারই বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। পাক বাহিনীর নির্দেশে শহীদদের মধ্যে মির্জা আব্দুল খালেক, আব্দুস সাত্তার ও নূরুল ইসলামকে একটি ধান ক্ষেতে গর্ত করে কবর দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় ব্যর্থ হয়ে মুক্তিযোদ্ধার দলটি সীমান্ত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরবর্তী রামচন্দ্র কুড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের বাড়িতে রাতের বেলায় আশ্রয় নেয়।
লালচান বেওয়ার ছেলে নূর মোহাম্মদ জানান, একবাড়িতে এতোজন মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয় নেওয়ার কথা গোপন রাখা যাবেনা। পাকিস্তানী চর রাজাকারদের নজরে এলেই সংবাদ পৌঁছে যাবে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে। তাই ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির লোকজন কৃষি শ্রমিক সাজিয়ে গরু, লাঙ্গল, জোয়াল, কোদাল সহ চাষের উপকরন দিয়ে তাদের সুকৌশলে বাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে বের করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বুড়ি ভোগাই নদীর পাশে ঘন জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পাক বাহিনীর শ্যেণ দৃষ্টি এড়িয়ে সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে তাদের কয়েকদিন লেগে যায়।
এই ক’দিন লালজান বেওয়া নিজের জীবন বাজী রেখে গভীর মমতায় ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পৌঁছে দিতেন। গ্রামের মানুষ যাতে টের না পায় তাই নদীতে বাসন মাজার ছল করে হাড়ি, পাতিল, গামলা করে ভাত, তরকারী নিয়ে যেতেন। কাপড় ধোঁয়ার ভান করে নদীর পানিতে কাপড় ভিজিয়ে তাদের তৃষ্ণার পানির যোগান দিতেন। মুক্তিযোদ্ধার দলটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে না পারা পর্যন্ত মমতাময়ী মায়ের মত ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধার দলটির মুখে আহার্য ও পানি তুলে দিয়েছেন। প্রায় শতবর্ষী লালজান বেওয়ার এ অবদানের মূল্যায়ন কেউই করেনি। তার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এখন তিনি ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। বয়সের কারণে কথা বলতে জড়তা আসে। তিনি শুধু মানবতাবিরোধী রাজাকার, আলবদরদের বিচার চান। শহীদদের স্মরনে ওখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়নি।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.