Published On: Sun, Jun 16th, 2013

ভালোবেসে বিয়ে করাই কি অপরাধ?

Share This
Tags

1290749409_1365493824    নোভার মন খারাপের কোনো কারন শাশুড়িকে বলতে চাইলে, শাশুড়ি ছেলের বউয়ের মন খারাপ লাগা ও ভালো লাগার বিষয়টি আমলেই দেন না। তার হাবভাব দেখলে মনে হয়, ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, যা বোঝার সে বোঝবে। পারছে না সে গর্ভধারিণী মাকেও তার দাম্পত্য জীবনের সব কথা খুলে বলতে। মা-মেয়ের মধ্যেও যেন কী এক অদৃশ্য দেয়াল দণ্ডায়মান থাকে। ঝরণা বলেন, শাশুড়ি পুত্রবধূ হিসেবে চেয়েছিলেন অল্প বয়সী, অল্প শিক্ষিত, ঘরকুনে বউ। আর তার মা চেয়েছিলেন, বাবার মতো কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে আমার বিয়ে হোক। এই আমি চেয়েছি, সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে মানসিক সমন্বয়। শ্রদ্ধা বোধ। দিয়েছি ভালোবাসার প্রাধান্য। এ কারণেই শ্বশুরালয় ও বাবা-মায়ের কিছুটা অমত থাকা সত্ত্বেও সহপাঠী হাসান মাসুদের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হই। ভেবেছিলাম দু’জনার পরিশ্রম, মেধা-মননের জোড়ে একদিন ঠিকঠিকই আমরা ঘরে-বাইরে প্রতিষ্ঠা পেতে পারব। তবে যতটা আশা করছিলাম ততটা পারছি না। এই ব্যয়বহুল জীবনে তো অর্থকষ্ট নিত্যসঙ্গী। পারছি না, নিয়মিত সামাজিকতা রক্ষার্থে পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতে। উপহারসামগ্রী বিনিময় করতে। চোক্ষুলজ্জার কারণে ওদের নিমন্ত্রণেও অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠে না। বিষয়টি বুঝে নিয়ে মা-শাশুড়ি দু’জনই মনোকষ্টে ভোগেন। তবে আর্থিক সাহায্যার্থেও এগিয়ে আসে না। আমি আমার স্বামী, উভয়ই বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়েও কোনো দাবি তুলি না এবং দু’জনই অধ্যায়টি এড়িয়ে যেতেও পারছি না। পারছি না, অভিভাবকদের সাথেও সহজ হতে। তারা ভাবেন আমরা অপরাধী। আর আমরা ভাবি, ভালোবেসে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। এখানে অপরাধবোধের কী আছে! এ ছাড়া আমরা পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায়, বাবা-মায়ের সম্পত্তির প্রতি অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। আছে তাদের সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারও। সে ক্ষেত্রে পছন্দই পাত্রপাত্রী বেছে নেয়াই কি একমাত্র অপরাধ!

শুধু নোভা নন। এমন সমস্যায় বর্তমান সময়ে অনেকেই ভুগছেন। এদের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার বিউটি বিশ্বাস বলেন, আমরা তিন বোন। আমি-ই বড়। যে কারণে ভালোবেসে ভিন্নধর্মাবলম্বীর ছেলেকে বিয়ে করায় উভয় পরিবার থেকেই হই সম্পর্কচ্যুত। এমনকি ভাই-বোনদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারি না। পৈতৃক সম্পত্তির প্রসঙ্গটি তো বাদই দিলাম। এ ছাড়া যতই ভালোবেসে বিয়ে করি না কেন, দু’জন পাশাপাশি থাকতে গেলে, ঝগড়া-বিবাদ, মন-কষাকষি তো হতেই পারে। থাকতে পারে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ খাপখাওয়াতে পারা না পারার বিষয়টিও, যা একমাত্র কাছের মানুষদের সাথেই যায় খুলে বলা। সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজে নেয়া। অথচ এই পরম আত্মীয়রাই যখন কেবল ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, তখন নিজেদের বড় অপরাধী ভেবে কষ্ট হয়। তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন করে, সন্তানদের অপরাধ কোনোক্রমেই কি ক্ষমা করার অযোগ্য? আর যদি তা হয়, কেবল ভালোবেসে বিয়ে করাই কি অপরাধ?

কথা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডাক্তার শিরিন সুলতানার সাথে। তিনি জানান প্রায়ই তিনি মনোকষ্টে ভোগেন, অতীতের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার জন্য শিরিন বলেন, মেডিক্যালে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় এলাকার এক প্রভাবশালী পরিবারের বেকার ছেলের প্রেমে পড়ে যাই। বছরখানেকের মধ্যে দু’জনার মতে বিয়ে হয়। বিয়ের পরে দুই পরিবারের পক্ষ থেকে কারো কোনো সাহায্য সহযোগিতা না পেয়ে মনে হচ্ছিল, আমরা ভুল করেছি। আবেগ দিয়ে আর যা-ই হোক জীবন চলে না (দু’জনার গড়া সংসারে একপর্যায়ে অভাব এতটা প্রকট হয়ে ওঠেছিল যে, বাধ্য হই সম্পর্ক ছিন্ন করার বিনিময়ে অভিভাবকদের কাছে আবার আশ্রয় নিতে। তবু সেই খণ্ডকালিন কষ্টগুলো আজও আমাকে ভাবায়। ভেবে কষ্ট পাই, ভালোবাসার মানুষটিকে ঘিরে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার রাখতে পারিনি বলে, যা দুই পরিবারের পক্ষ থেকে সামান্যতম, সহানুভূতি সহযোগিতা থাকলে আজও হয়তো আমাদের সম্পর্ক, বিয়ে স্থায়ী থাকত। নীরবে বারবার স্মৃতির খাতা খুলতে হতো না। ফেলতে হতো না দেশ, সমাজসেবা, পরিবারের সবার সর্বাঙ্গিণ মঙ্গল কামনায় এবং তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেয়ার অজুহাতে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিতে হতো না বলেও জানান ডাক্তার শিরিন সুলতানা।

এ বিষয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপিকা তাসলিমা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে ভালোবাসার বিয়েকে অভিভাবক, পরিবার, সমাজ প্রায় সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। বরং কেউ কেউ সন্তানদের এ সিদ্ধান্তে স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলছে। আগাম ভেবে নিয়ে, যাতে ভবিষ্যতে সন্তানরা সম্পর্ক গড়ার বিষয় কোনোরূপ দোষারোপ করতে না পারে। তবে কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানদের নিজস্ব পছন্দের বিয়েকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। সন্তানকে ঘিরে আশাভঙ্গের কষ্টে ভোগেন, যা থেকে মান-অভিমান এমনকি ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়। তাই পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। মনের ভাব আদানপ্রদান করা। যাতে উভয়েরই মতামত উভয়ের জানা থাকে। কারোই হঠাৎ আঘাত পেতে না হয়। সে অনুযায়ী সন্তানদের ঘিরে আগাম চিন্তাভাবনার সঙ্কোচন ও বিস্তার ঘটাতে। তবে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতেই হচ্ছে। সন্তান যদি আবেগের বসবর্তী হয়ে ভুল করেই ফেলে তবে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে সংশোধনের কাজ কিন্তু আপনার। আর সন্তানেরাও বোধ করি জানেন, বাবা মায়ের সর্বাঙ্গিক চাওয়া সন্তানের সাফল্য-সুখ। আর তা যদি কোনো বিশেষ একজনকে কেন্দ্র করে হয়, তা তাদেরকে বুঝিয়ে বললে, অবশ্যই বিষয়টি তারা গুরুত্বের সাথে নেবেন, যা উভয়ের জন্যই হবে সুখ স্বস্তিকর বলেও জানান অধ্যাপিকা তাসলিমা বেগম।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.