বগুড়ার দই নাকি দইয়ের বগুড়া
বগুড়ার দইয়ের সাতকাহন
বগুড়া শব্দটা আলোচনায় এলেই চলে আরেকটা শব্দ। দই। বগুড়ার দই। উত্তরবঙ্গের ‘গেটওয়ে’ বলে পরিচিত বগুড়া জেলা। কিন্তু দই কথাটা যেন এই জেলার নামের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার দইয়ের সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
বগুড়ায় বাহিরের কেউ বেড়াতে এলে তার যেন দইটা চাখা চাই-ই চাই। এই জেলা থেকে বাহিরে বেড়াতে গেলেও তার সঙ্গী হয় দই। তাছাড়া বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ।
বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নিতে যে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বীকার করেন, অন্য এলাকার দইয়ের সাথে এখানকার দইয়ের স্বাদ অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা অবশ্য প্রশংসার দিকেই ঝুঁকে থাকে। মোট কথা, বগুড়া আর দই শব্দগুলো সময়ের হাত ধরে একে অন্যের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বগুড়ার দই আর দইয়ের বগুড়া- এই কথাগুলো যেন সমান্তরাল। আন্তরিক এক আত্মীয়তার মুখরোচক শিরোনাম !
দইয়ের দিগন্ত আদি অন্ত—
দই বগুড়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার। ব্যাপক প্রচলনের কারণে এটি সামাজিকতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে উৎপাদন ও বিপনন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা। দই তৈরির প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনও হয়েছে ব্যাপকভাবে। বানানগত দিক থেকেও ঘটেছে পরিবর্তন। আগে খাবারটি নাম লেখা হতো “দৈ”, অনুমান করা যায়, এখন থেকে প্রায় ২শ বছর আগে। সাধারণত ঘোষ নামে পরিচিত পরিবারগুলো এই শিল্পের সূচনা করেন। বাড়িতে তৈরি করে, দুটি ডালায় বোঝাই করে কাধে ঝুলিয়ে গ্রামে পথে পথে আর হাট-বাজারে নিজেরাই বিক্রি করতেন তারা। চাহিদার কারণে নিজেদের বাড়িতে কিংবা হাটের কাছে স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র খুলতে হয় তাদের। প্রতিটি উৎপাদনকারীর ছিল নিজস্ব পদ্ধতি। চাহিদার ভিত্তিতে তারা দইয়ের স্বাদ পরিবর্তন করতেন। নিয়ন্ত্রণ করতেন মান ও মূল্য। গোপন রাখতেন দই তৈরির ফরমুলা।
বগুড়ার দই প্রথমবারের মতো দেশের বাহিরে যাত্রা করে ১৯৩৮ সালে। ওই বছরের গোড়ার দিকে তৎকালীন বাংলার বিট্রিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ায় আসেন। তিনি বগুড়ার নওয়াব বাড়ির আতিথ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো বগুড়ার দইয়ের স্বাদ নেন। তার জন্যে কাঁচের পাত্রে তৈরি করা বিশেষ ধরনের দই সরবরাহ করা হয়। দইয়ের স্বাদ তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে, তিনি এখানকার দই ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানও মেতে যান বগুড়ার দইয়ের সুস্বাদে। শোনা যায়, বিট্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পেতে তিনি সেখানকার কর্মকর্তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে বগুড়ার দই পাঠিয়েছেলেন। শহরকেন্দ্রীক দই উৎপাদনের বিষয়টি মোটামুটি দেড়’শ বছর আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় শুরু হয়। এর সূচনাকারীরাও ছিলেন ঘোষ সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্যমী মানুষটির নাম গৌর গোপাল।
তিনি দইয়ের স্বাদ ও মানে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শেরপুর উপজেলা থেকে ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এসে তিনি বগুড়া শহরে দই ফেরি করে বিক্রি করতেন। তার তৈরি করা দইয়ের স্বাদ পেয়ে উচ্ছ্বসীত হয়ে ওঠেন তৎকালীন পাকিস্তানের নওয়াব মোহাম্মদ আলী। তিনি গৌর গোপালকে বগুড়া শহরে বসত এবং দইয়ের কারখানা স্থাপনের জায়গা করে দেন। প্রথমদিকে তিনি শুধু বগুড়ার দুটি নবাব পরিবারের জন্যই দই তৈরি করতেন। পরে তার ভাই সুরেন ঘোষের সাথে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে বগুড়ার দইয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেন ঘোষ পবিারের আরেক সদস্য কুরানু ঘোষ।
এরপর দই শিল্পে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়া করান মহরম আলী। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া হোটেলও দই ব্যবসায় এগিয়ে আসে। ১৯৮৫ সালে আহসানুল কবির তার ‘দই ঘর’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দই শিল্পে নিয়ে আসেন আধুনিকায়ন। দই তৈরির প্রক্রিয়া, প্যাকিং এবং বিপননে তার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি দইশিল্পের নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়। স্বাদের উন্নতি এবং পরিবহনের সুবিধাজনক পদ্ধতির কারণে বগুড়ার দই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সম্প্রতি দইয়ের স্বাদে নতুনত্ব আনায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এশিয়া সুইটমিট। এছাড়াও শ্যামলি, রুচিতা, চিনিপাতা, সাউদিয়া, দইবাজার, ফুডভিলেজ নামের আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান দই উৎপাদন এবং বিপনন করছে বগুড়ায়।
দইয়ের রকমারি
প্রথম অবস্থায় বগুড়ার দই উৎপাদন হতো শুধু টক স্বাদে। সেটার সাথে গুড় বা চিনি মিশিয়ে খেতে হতো। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় মিষ্টি স্বাদ। টক দইও উৎপাদন হয়। ঘোল ও রোষ্ট তৈরিতে কাজে দেয় এটা। ইদানিং ডায়াবেটিক রোগিদের জন্য তৈরি হচ্ছে সাদা দই।
দইয়ের স্বাদের আধুনিকায়ন হলেও দই রাখার পাত্রটি থেকে গেছে আদি অবস্থাতেই। কুমারদের তৈরি করা পোড়া মাটির পাত্রে এখন দই তৈরি ও সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রথমদিকে ‘ডুঙ্গি’ নামের একটি পাত্রে দই বেশি তৈরি করা হতো। ডুঙ্গি দেখতে কিছুটা মাটির কলসির মতো। তবে একাধিক দইয়ের ডুঙ্গি প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে বলে এর ব্যবহার কমেছে। এখন মাটির বাটি, হাঁড়ি ও সরার দই বেশি তৈরি হয়। এর মধ্যে সরার দই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। মাটির সানকির মতো দেখতে চ্যাপ্টা থালাকে ‘সরা’ বলে। বিশেষ কারণেই সরার দইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। দই তৈরির প্রক্রিয়ার সময় উপরের অংশে সুস্বাদু, ঘন জমাট বাঁধা একটি স্তর পড়ে। সরার মুখটি চওড়া হওয়ায় এতে সেই বিশেষ অংশটি বেশি পাওয়া যায়। এছাড়াও ছোট মাটির গ্লাসেও দই বিক্রি হয়। ৫শ গ্রাম দইয়ের মূল্য মানভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা হয়।
দইয়ের সঙ্গীসাথী
বগুড়ার দইয়ের পাশাপাশি ‘খিরসা’ নামের একটি খাবার পাওয়া যায়। এটির মূল উপাদান দুধ। ‘খিরসা’ দইয়ের চেয়ে ঘর ও মিষ্টি হয়ে থাকে। এর দামও বেশি। দুধভিত্তিক শিল্প হিসেবে দই-‘খিরসা’ পাশাপাশি মিষ্টি উৎপাদনেও বগুড়ার সুনাম আছে। এসব শিল্পের সাথে অসংখ্য মানুষ জড়িত। দুধ উৎপাদন, সংগ্রহ ও সরবারহের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্য মানুষের। বিশেষ করে দই রাখার পাত্র হিসেবে পোড়া মাটির পাত্র ব্যবহার করায় উপকৃত হচ্ছে কুমার সম্প্রদায়।
সম্ভবনা সমস্যা
দইশিল্পের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কথা হলো দইঘরের প্রতিষ্ঠতা আহসানুল কবিরের সাথে। তার মতে, মান ধরে রাখতে পারলে বগুড়ার দইশিল্পের সম্ভবনা খুব আশাব্যঞ্জক। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান দইয়ের মানের ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখছে না। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানের দইয়ের বাজারমূল্য কম দেখালেও স্বাদের ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটছে। ফলে বগুড়ার দইয়ের সুনামের প্রশ্ন নিয়ে দ্বন্দ দেখা দেয়।
যেহেতু এই শিল্পের সাথে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের প্রশ্ন জড়িত তাই এটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাদ ও মান নিয়ন্ত্রণ না করলে বগুড়া দই হারিয়ে ফেলতে পারে তার সুনাম।