নারী ও আমাদের মিডিয়া জগত( একাল- সেকাল)
ডেস্ক রিপোর্ট– ফারিয়া রিসতা
নারী আজ এক উদীয়মান সুর্যের নাম, নতুন প্রত্যয়ের নাম। কালে কালে যুগে যুগে যে নারীরা ছিল অবহেলিত,অপমানিত আর অন্ধকারে নিমজ্জিত তারাই আজ মহাকাশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাখছে সফল পদচারনা। নারীদের এই পদচারনার এক অন্যতম উদাহরন হল- মিডিয়া।
মিডিয়া বা গনমাধ্যম বলতে আমরা যেসন ক্ষেত্রকে বুঝি তা হল-
• শ্রবণ সম্বন্ধীয়- রেডিও, ক্যাসেটস, সিডি, সেলুলার ফোন ইত্যাদি
• শ্রবণ-দর্শণ সম্বন্ধীয়- ছায়াছবি/চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, ভিডিও, মঞ্চ, নাটক, ইন্টারনেট ইত্যাদি
• দর্শণ সম্বন্ধীয়- ছবি, পোস্টার, কার্টুন, শিল্পকলা, পেইন্টিং ইত্যাদি
• মুদ্রণ শিল্প- সংবাদপত্র, বই, ম্যাগাজিন লিফলেট ইত্যাদি
গণমাধ্যমে নারীর বর্তমান চিত্র জানতে এখানে রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, পোস্টার, সংবাদপত্র এবং বিকল্প মাধ্যম অর্থাৎ ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেয়া হবে।
প্রথম যেদিন এদেশে টেলিভিশনের প্রচলন হল, তখন থেকেই প্রচলন ঘটে বিজ্ঞাপন এর মাধ্যমে পন্যের প্রচারের, আর তখন থেকেই বিজ্ঞাপন জগতে পা রাখেন এদেশীয় নারীরা। মাথার তেল থেকে রান্নার মসলা, ইলেট্রনিক্স থেকে শুরু করে ঘরের ফার্নিচার সব বিজ্ঞাপনেই দেখা যায় নারীদের। শুরুর দিকে ব্যাপারটা নারীদের সাহস ও সাবলম্বীতার ক্ষেত্রে পজিটিভ মনে হলেও ইদানীং পন্যের বিজ্ঞাপনে নারীকেই আসলে ব্যাবহার করা হচ্ছে পন্য হিসেবে। একটি দরজার বিজ্ঞাপনে স্লিভলেস ব্লাউজ পরা একজন মেয়ে বা টিভির বিজ্ঞাপনে স্নানরত মেয়ের ছবি পন্যের মান সম্পর্কে কতটা ধারনা দেয় জানি না তবে পন্য হিসেবে মেয়েদের প্রদর্শন ঠিক ই করছে। নব্বইয়ের দশকে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে যে সব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো বর্তমানে তা আরও আকর্ষণীয়, জৌলুসপূর্ণ ভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে, বদলে গেছে উপস্থাপনের ধরণ। তবে তারপরও বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় তা সাধারণত নেতিবাচক। একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় দেখা যায়বিশেষ একটি ব্র্যান্ডের টিভি স্বামীর (!) বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের অনুষ্ঠানেই জেদ ধরে মেয়েটি। এধরনের বিজ্ঞাপন যৌতুকের মতো ঘৃণ্য প্রথাকে প্রকারান্তরে সমর্থন করে। আবার মুখের ক্রিমের বিজ্ঞাপন গুলোতে দেখানো হচ্ছে মেয়ে কালো বলে বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আর সেই নির্দিষ্ট ক্রিম মাখার কারণে রং ফর্সা হওয়াতে নতুন উদ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে এখানে মেয়ের গুণ নয় বরং রূপকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।।আর এসব বিজ্ঞাপন প্রকারান্তরে বর্ণবাদকেই উসকে দেয়। যত মসলার বিজ্ঞাপন আছে তার সবটা জুড়ে থাকে নারী, যেখানে সুবিধাভোগী হিসেবে পুরুষকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এমনও দেখা যায় স্বামী –স্ত্রী উভয়েই সারাদিন অফিস করে এসে স্ত্রী ঢুকলেন রান্না ঘরে আর স্বামী সংবাদপত্র পড়ে, টিভি দেখে সময় পার করছেন এবং টেবিলে এসে রান্না মুখরোচক কম হওয়াতে স্ত্রীকে বকাবকি করছেন। এবং সেই মসলায় রান্নার মুখরোচক হওয়া খাবারে সংসারে শান্তি ফিরে আসে।
কিন্তু পণ্যের উৎপাদক ও বিক্রেতা নারীর ইতিবাচক ভূমিকাকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন মাত্রায় দেখানো হলে একদিকে পণ্যের প্রচার ও হয় আর অন্যদিকে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে একটি চায়ের বিজ্ঞাপনে নারীকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে বরং নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটাতে বলা হচ্ছে। অন্য একটি ফলের জুসের বিজ্ঞাপনের নারীর নির্দিষ্ট একটি ফল নিয়ে ভবিষ্যত ভাবনার উপস্থাপন এবং বার্ধক্যে তার সেই ভাবনার বাস্তবরূপ দেখানো অন্য বিজ্ঞাপনের তুলনায় এধরনের বিজ্ঞাপনের প্রচারে প্রসার কোন অংশে কম নয় বরং বেশিই হতে পারে।
আর শুধু বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহনেই নারীরা আজ ক্ষান্ত নয়। বিজ্ঞাপন বানানোতেও দেখা যায় তাদের সফল পদচারনা। বিভিন্ন অ্যাড ফার্মে আজ তাই কাজ করে চলেছে এই নারীরা।
এত গেল বিজ্ঞাপন জগতের কথা, বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি নাট্যজগত আর সিনেমা জগতে নারীরা আজ পুরুষের পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়ে চলেছে। যার ফলসুত্রিতে আজকাল নির্মিত হচ্ছে নারী চরিত্র প্রধান নাটক ও সিনেমা। অভিনয় জগতের পাশাপাশি চিত্রনাট্য লেখা, পরিচালনার মত বিষয়ে ক্যামেরার পিছেও নারীদের প্রতিভা ও গুরুত্ব কেও প্রকাশ করে। পুর্ব থেকেই নাটকে প্রকাশিত হয়ে এসেছে এদেশের নারীদের বাস্তব চিত্র, যার প্রেক্ষিতে কখন ও নারীর মাতৃরূপ, অত্যাচারিত রূপ, অবহেলিত রূপ এর পাশেপাশি নাটকে প্রকাশ পেয়েছে তাদের সাহসী রূপ, প্রতিবাদি রূপ, প্রেমিকা রূপ কর্মজীবী রূপ।কিন্তু সাধারণত আমাদের দেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ দর্শক হলেন নিম্নবিত্ত শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু এসব চলচ্চিত্রে নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে মনে হয় একজন কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর একমাত্র কাজ হচ্ছে প্রেমে পড়া । তাকে লেখাপড়া করতে হয় না, লাইব্রেরী ওয়ার্ক করতে হয় না, এমনকি পরীক্ষা নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হয় না। এখানে নারীর ভুমিকা হলো নায়কের চারপাশে নাচগান করা, অসহায় হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, নির্যাতিত হওয়া (সিনেমার নাম মনে নেই আলেকজান্ডার বো আর মুনমুন মুল চরিত্রে, যেখানে মযুরীরর কাজই ছিলো রেপ হওয়া), নায়ক বা কোন পুরুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি। সাধারণত মূল ঘটনায় নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় নারীকে দেখা যায় না। একসময়ের সেনেমার পদা কাঁপানো নারীকুল শিরোমনি শ্রদ্ধেয় “শাবানা”-র কাজই ছিলো স্বামী, শ্বাশুরী, ননদদের হাতে নির্যাতিত হয়ে অবহেলিত লাঞ্ছিত জীবন যাপন করতে। স্বামী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরলেও শাবানা ম্যাডাম সেই মাতাল স্বামীর ঘাম মুছে “ওগো” “হ্যাঁগো” বলে স্বামীর পায়ের জুতা খুলে দিতে। ইদানীং কালের চলচিত্রেও যে সেই অবস্থার খুব পরবর্তন হয়েছে তা বলতে পারছি না। সাধুবাদ জানাই নতুন কিছু পরিচালক দের যারা এই অবস্থার পরিবর্তনে আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জেগে ওঠা চলচিত্র জগত কে নিয়ে আশা করা যায় যে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের চলচিত্রকে পরিবর্তনের পাশাপাশি চলচিত্রে নারীর পরিবেশনাকেও পরিবর্তন করা হবে।
আজ থেকে ১০ বছর আগেও মনে করা হত মিডিয়ায় কাজ করা মেয়ে মানেই খারাপ চরিত্রের, আর তার উপর মেয়ে যদিবা হয় সাংবাদিক তবে খারাপের সাথে হয়ত আরো বেশ কয়েকবার খারাপ শব্দটা যোগ করা হত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধারনা পাল্টেছে মানুষের, আর সেই ধারনা বদলাতে সার্থক ভুমিকা রেখেছে এই মেয়েরাই। আজ একজন ছেলে সাংবাদিকের সাথেসাথে মেয়ে সাংবাদিক কেউ দেখা হয় সম্মানের সাথে। সংবাদ পরিবেশন বা সাংবাদিকতা এই দুইটাতেই এখন মেয়েদের সব থেকে বেশি সফল পদচারনা। অকুতোভয় মেয়েগুলো আজ কলম বা ক্যামেরার সাথে ছুটে চলছে সংবাদের পিছে আবার সেগুলোকে সুন্দর করে গুছিয়ে পরিবেশন করছে এই মেয়েরাই।
রেডিও জগতে যদি দেখি তবে দেখব সেখানেও কিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নারী তার সফলতার পদচিহ্ন রেখে সামনে এগিয়ে চলছে- কোন সফল আর জে হিসেবে অথবা এফ এম এর একজন সফল পরিচালক হিসেবে।
ইন্টারনেট কে বলা যায় নারী সফলতার আরেকটি মোক্ষম প্রমান। ফেসবুক হোক বা ব্লগ বা ফ্রিল্যান্সীং সব ক্ষেত্রেই নারী রা নিজেদের প্রমান করে চলেছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যাবহার কারী দের মধ্যে একটি বিশাল পরিমান ইউজার এই নারীরাই। নারীদের প্রতিভা বিকাশের সহায়ক রূপে এই ফেসবুক, ব্লগ বা অন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট গুলো যেমন সাহায্য করছে তেমনি ফ্রিল্যান্সীঙ্গের মাধ্যমে নারিরা সুযোগ করে নিচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, সেই সাথে নিজেদের করে তুলছে স্বাবলম্বী।
সে রাধে, সে চুল ও বাধে- প্রবাদ টি নারীদের জন্য হলেও এই মোক্ষম প্রমান হল এই মিডিয়া জগত। এখানে নারীরা যে খুব সুগম পথ পেয়েছে তা বলব না। প্রতিপদে হয়রানির শিকার হতে হলেও সামনে আগানোর পথে তারা সব বাধাকে উপেক্ষা করতে সক্ষম করতে সফল হয়েছে। যার কারনে গত ১০ বছরেই বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এই মিডিয়া জগতে। নারীরা তাদের সাহসী পদচারনাতেই এই জগত কে সহজ করে তুলেছে সাধারন মানুষের মাঝে। যার কারনেই আজ একটি মেয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে একজন সাংবাদিক পরিচালক বা অভিনেত্রী হওয়ার। এইসব সাহসি নারীদের দেখলেই চিৎকার করে বলে উঠতে মন চায়- জয় নারী, জয় নারীত্ব।