Published On: Thu, Jun 20th, 2013

‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ ও এলিয়ট

Share This
Tags

tseliot2রিজওয়ান করিম :

টি.এস.এলিয়ট যখন তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ লিখেন, সময়টা তখন ১৯২২ সাল। কিন্তু এলিয়ট এবং তাঁর কবিতা, বিশেষত এই কবিতাটি যে বর্তমানেও এতটা আলোচিত ও পঠিত, তার কারণ বোধকরি ওই কবিতার অন্তর্গত দৃশ্যগুলো আশ্চর্যরকমভাবে মিলে যায় এ সময়ের আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে।

এলিয়টকে বলা হয় কবিদের কবি। তার আগে বোদলেয়ার, মিল্টন এবং দান্তেকেও এই রকম বলা হতো। বাংলা কবিতা এলিয়টের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। বাংলা কবিতার পাঠকেরা জানেন, তিরিশের আধুনিক কবিরা কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন এলিয়টের কবিতা পড়ে। এলিয়টের উপর বাংলা কবিতার আধুনিকতাবাদ অনেকটুকু নির্ভর করেছে একসময়। আর তিরিশ ও তৎপরবর্তী কবিরাও ভাষা, শৈলী ও বিষয়বস্তুতে এলিয়টকে ধারণ করেছেন।

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথও এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন। এলিয়টের এই যে বৈশ্বিক প্রভাব, সেটি আসলে নিহিত তাঁর লেখনীর ভেতরেই। এলিয়ট বিংশ শতাব্দীর কবিতায় যে ধারাটির সংযোজন করেন তাতে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যটি ব্যাপক হয়ে পড়ে, যুক্তি আকর্ষণ প্রয়োজনীয়তা পায়। আবার এই তিনিই যখন নিমগ্ন কোনো আধ্যাত্মচিন্তায়, তখন যুক্তি-বুদ্ধি-সত্যকে খাটো না করে বরং তা থেকেই ভেতরের যাত্রাটির সূচনাকে চিহিৃত করেন। আমাদের সময় এলিয়ট ছাড়া আর কোনো কবি এভাবে দুটি ভিন্ন সমতলে আমাদের চেতনাকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এলিয়েট তাই একান্তই স্বতন্ত্র একটি ধারার সৃষ্টি করেছেন এবং কে না জানে, যে কোন কবির জন্যই এই স্বাতন্ত্র্য কতটা আরাধ্য। এলিয়টের আরো একটি বিশেষ অবদান এই যে, তিনি ইংরেজি কাব্যের ভাষাকে সংষ্কার করেছেন। এলিয়ট কবিতার ভাষাকে নিয়ে এসেছিলেন মুখের ভাষার কাছাকাছি। সাহিত্যে বিপ্লবের মানেটা আর কিছুই নয়, তা হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষার কাছে ফিরে আসা- এই উপলব্ধিটুকু এলিয়টই বারবার আমাদেরকে দিয়েছেন।

এলিয়টের জন্ম ১৮৮৮ সালে আমেরিকায়, ১৯১৫-তে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ইংল্যান্ডে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন প্রথমে, পরে পড়াশোনা করেছেন সরবোন ও অক্সফোর্ডে। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে এবং তাঁরই উদ্যোগে ‘ক্রাইটেরিয়ান’ নামের সেই বিখ্যাত পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। এই পত্রিকাতেই ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতাটি। ১৯২৭ সালে এলিয়ট গ্রহণ করেন ব্রিটিশ নাগরিকত্ব। এই সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, সেটা হলো তাঁর ক্যাথলিসিজমে ধর্মান্তর। এরও একটা বিশেষ প্রভাব পড়েছে তাঁর কবিতায়। ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় এলিয়টকে দেখি যে তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু ওই এলিয়টই তাঁর আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘ফোর কোয়ারটেটস্’-এ এসে সেই পথটাই যেন খুঁজে পেলেন ধর্মে ও আধ্যাত্মিকতায়। কিন্তু সে পথ কতটা মুক্তির আর কতটা পিছিয়ে যাওয়ার, সে প্রশ্নটা অবশ্য থেকেই যায়।

অন্যান্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকের মতো এলিয়েটও আটকে গেছেন একখানে এসে। বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যকে অবশ্য মোটেই খাটো করে দেখবার উপায় নেই, যেমনটা নেই এলিয়টের অবদানকে অবমূল্যায়ন করার। কিন্তু এলিয়টসহ আধুনিক সাহিত্যিকদের অনেকেই আক্রান্ত ছিলেন সীমাবদ্ধতায়।

ফিরে আসা যাক এলিয়টের কাব্যে, বিশেষ করে ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’-এ। এ কবিতায় আমরা দেখি আধুনিক মানুষের কোন পূর্ণাঙ্গ ভূখণ্ড নেই। যে জমিতে মানুষ পড়ে আছে সেখানে ফসল নেই, রস নেই, জল নেই, গাছপালা নেই, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নির্মল বাতাস নেই, কথা বলার মানুষ নেই। কেননা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই পুড়ে গেছে। আমরা আরও দেখি, এই পোড়ো, দগ্ধ জমিতে মানুষও অনুপস্থিত। যে সব চরিত্রকে এখানে দেখা যায় তাদের চেহারাটা অনেকটা ভুতের মতো। আর ভুতের মতো বলেই তাদের কোন নির্দিষ্ট আবাস নেই, বিনাশও নেই। এলিয়ট কবিতায় এ ইঙ্গিতটা দেন যে, মৃত্যুবরণ করার ক্ষমতাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে এবং এ কারণে বোতলের ভেতরের ভুত কেবল পুড়তে থাকবে। এর কোন পরিত্রাণ নেই, পথও নেই বেরিয়ে পড়বার।

এ রকমই আরেকটি মর্মন্তুদ কাহিনী আমরা দেখি এলিয়টেরই ‘প্রুফকের প্রেমসঙ্গীত’ নামের কবিতাটিতে। ওইখানে ‘প্রুফক’ নামের একজন মানুষ এক অসহায় বৃত্তে আটকা পড়ে আছে। ও কথা বলতে চায়, কিন্তু তার পৃথিবীতে সংলাপ নেই। সেখানে গতি থাকলেও থাকতে পারে, তবে গন্তব্য অনুপস্থিত। এই বদ্ধ, অসহায়, সিদ্ধান্তহীন মানুষটার মর্মবেদনা এলিয়ট বুঝতে পারছেন, কিন্তু যেন মুক্ত করতে পারছেন না তাকে। প্রুফক আটকে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এলিয়টও। আর এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিচ্ছিন্নতাও বেড়েছে। বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করার জন্য সামনের দিকেই যে যেতে হবে, পেছনে নয়- এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাটা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে আসেনি বলেই শুধু এলিয়ট নন, তাঁর সমসাময়িক আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকেরাও মানুষের মুক্তির পথটা নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তাঁর বিভিন্ন কবিতায় এলিয়ট একজন আধুনিক মানুষের যে সামগ্রিক সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন ওটি আসলে পুজিঁবাদেরই সংকটের চিত্র। তাঁর একটি ইতিবাচক অবদান এইখানেই যে, তিনি পুজিঁবাদের সংকটকে কাব্যিক অভিজ্ঞতায় ধারণ করেছেন। পণ্য ও পুঁজিকে মুখ্য করতে গিয়ে মানুষকে গুরুত্বহীন, পতিত করার পুজিঁবাদের যে স্বভাবজাত মানসিকতা, ওই প্রপঞ্চটিই ঘুরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়। সমস্ত ‘ওয়েইষ্ট ল্যান্ড’জুড়েই মানুষ বিরাজ করে পতিত প্রাণী হিসেবে। যন্ত্র সেখানে উঠে আসছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু মানুষ শুধুই পড়ে যাচ্ছে ও পিছিয়ে পড়ছে। এলিয়টের পৃথিবীতে পণ্যের চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য আছে, যেটিকে আবরণ হিসেবে মেলে ধরে পুজিঁবাদ আড়াল করে রাখে তার অন্তর্গত সংকট ও প্রতারক চেহারাটি।

‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই এলিয়ট একটি রমণীয় চেয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বর্ণনাতে মনে হয় যেন ওটি চেয়ার নয়, সিংহাসনই যেনবা। আর যিনি চেয়ারে বসে আছেন সেই মানুষটি মুখ্য নয়, এমনকি মুখ্য নয় তার বসে-থাকাটাও; বড়ো বিষয় হচ্ছে চেয়ারটি নিজেই। পণ্য বিকশিত হবে, পুঁজি ফুলেফেঁপে উঠবে; কিন্তু মানুষ সম্ভাবনাহীন থাকবে, আটকে থাকবে বোতলের ভেতরে অথবা কারাগারে অথবা বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে – এই পুঁজিবাদী ধারণার উর্দ্ধে উঠতে পারেননি বলেই এলিয়ট চিহিৃত করতে পারেননি মানুষের মুক্তির পথটা। সংকটের চিত্র তিনি এঁকেছেন, কিন্তু সংকটের কারণগুলো তিনি গভীরভাবে নির্দেশ করতে পারেননি। আর কারণগুলো ধরতে পারেননি বলেই, তাঁর হাজারো ইতিবাচক ও মৌলিক অবদান স্বত্বেও, যখন মুক্তি খোঁজার তাগিদ এলো, তখন মুক্তির নামে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে, যেতে পারেননি সামনে।

কিন্তু মানুষের ইতিহাস তো পেছনের দিকে যাবে না; সে যাবে সামনের দিকেই। ক্রমাগত সংকট থেকে উত্তরণের, অর্থাৎ সামাজিক পরিবর্তনের কাজটুকুও চলবে অবিরত। তবে সমাজকে শুধু রাজনীতিই বদলাবে না, সে কাজটা সাহিত্যও করবে, নিজের মতো করেই। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই উপলব্ধিটুকু গুরুত্বপূর্ণ যে, বলাটাই সব নয়, বদলানোটাও জরুরী। এ বদলানোর ঢঙটা যদিও ভিন্ন হতে পারে। আর এই বদলানোর অঙ্গীকার এবং কর্মপ্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে পিছুটান। লেখকদের, বিশেষত সচেতন লেখকদের বিরাট একটা দায়িত্ব সেটাকে চিহিৃত করা যাতে শুধু তিনি নন, পাঠকও এগিয়ে যেতে পারে সামনের দিকে, ক্রমাগত।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.