Published On: Thu, May 1st, 2014

ছয় লাশ মিলল শীতলক্ষ্যায়

Share This
Tags
pic-25_78986নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হওয়ার তিন দিন পর গতকাল বুধবার বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল রাত পর্যন্ত কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকার, নজরুলের সহযোগী ও যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দনের গাড়িচালক ইব্রাহিমের লাশ শনাক্ত করেছে স্বজনরা। বাকি লাশটি নজরুলের সঙ্গে অপহৃত তাঁর সহযোগী ও যুবলীগকর্মী লিটনের বলে ধারণা করা হলেও রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অপহৃত আরেকজনের খোঁজ গতকাল রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
পুলিশ কর্মকর্তা, নিহতদের সহকর্মী ও স্বজনরা বলছে, ছয়জনকেই হত্যার পর পেট কেটে সিমেন্টের বস্তায় ভরে ইট বেঁধে নদীতে ফেলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তিন দিন আগেই তাঁদের হত্যা করা হয়। যেখানে তাঁদের পাওয়া যায়, সেখানেই তাঁদের লাশ ফেলা হতে পারে, আবার অন্য স্থানে ফেলার পর লাশগুলো ভেসে কলাগাছিয়ার নদীতেও আসতে পারে।
এদিকে নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের ঘটনায় গতকালও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জ। দুপুর পর্যন্ত নজরুলের সমর্থকরা কয়েকটি স্পটে অবরোধ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক অবরুদ্ধ করে রাখে। দুপুরে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারের পর লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা নারায়ণগঞ্জে। বিশেষ করে নজরুলের এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে দফায় দফায় চলে বিক্ষোভ। রাস্তা অবরোধ করে যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট তছনছ, পেট্রল পাম্পে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। এর ফাঁকে লুটতরাজের মতো অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় অনেক জায়গায়। পাঁচজনের লাশ শনাক্ত করে বিলাপ আর ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্বজনরা। কান্নার রোল চলছে এখনো নিখোঁজ একজনের পরিবারেও। তাঁকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনার আলোটুকুও আর দেখছেন না স্বজনরা।

অন্যদিকে সাতজনকে অপহরণ এবং তিন দিন পর ছয়জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল শীতলক্ষ্যা থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধারের এক ঘণ্টা আগেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, সাতজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। দ্রুতই তাঁদের পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক অপহরণের ঘটনায় ব্যর্থতার পর গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, র‌্যাব-১১-এর অধিনায়কসহ পাঁচজনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। এখন লাশ উদ্ধারের পর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যেভাবে লাশ উদ্ধার : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল  দুপুর পৌনে ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় ছয়টি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে স্থানীয় লোকজন একটি লাশ ভাসতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও ভাই আব্দুস সালাম নজরুলের লাশ শনাক্ত করেন। খবর পেয়ে শীতলক্ষ্যার তীরে ছুটে আসে নজরুলের স্বজন, সহকর্মী, এলাকাবাসীসহ হাজার হাজার মানুষ। বিকেলে শতীলক্ষ্যা-ধলেশ্বরী নদীর ওই মোহনা থেকে একে একে ছয়টি লাশ উদ্ধার করে তীরে রাখা হয়। এরপর স্বপনের ছোট ভাই রিপন এবং তাজুলের ছোট ভাই রাজু তাঁদের লাশ শনাক্ত করেন। চন্দনের গাড়িচালক ইব্রাহিমের লাশ শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী হনুফা বেগম। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। ময়নাতদন্তের জন্য ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে রাত সোয়া ৮টার দিকে চন্দনের ভাগ্নে প্রিয়তম কুমার দেব তাঁর মামার লাশ শনাক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চন্দন কুমার সরকারের বাম হাতের ব্রেসলেট ও ডান হাতের আংটি দেখে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানান ভাগ্নে।
বন্দর থানার ওসি আকতার মোর্শেদ কালের কণ্ঠকে জানান, উদ্ধার হওয়া সব কয়টি লাশেরই পেট ফাড়া (লম্বা করে কাটা) অবস্থায় মুখ পলিথিন দিয়ে এবং হাত-পা পাটের রশি দিয়ে বাঁধা ছিল। প্রতিটি লাশ সিমেন্টের বস্তায় ভরে ইট বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। লাশগুলো ফুলে কচুরিপানার মধ্যে ভেসে ওঠে। নজরুলের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা। তাঁর লাশটিই প্রথম তোলা হয়। প্রতিটি লাশের সঙ্গে ২৪টি করে ইট বাঁধা ছিল। ওসি আরো বলেন, ‘আলামত দেখে ধারণা করা যাচ্ছে, অন্যস্থানে ফেলার পর লাশগুলো ঘটনাস্থলে ভেসে এসেছে। আবার হত্যার পর এ স্থানেই ভেসে উঠতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
গতকাল রাত পর্যন্ত ছয়জনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নজরুল ইসলামসহ চারজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার মো. আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, নিহতদের গলায় রশি বাঁধা ছিল। লাশের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। নজরুলের মাথার পেছনে এবং বুকে আঘাতের চিহ্ন আছে।
এখনো অন্ধকারে পুলিশ : সাত ব্যক্তি অপহরণের পর ছয়জনের লাশ উদ্ধারের চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পরও পুলিশ জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গত চার দিনেও সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকেই আইনের আওতায় আনা যায়নি। অপহরণ বিষয়ে ব্যর্থতার দায়ে গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের পাঁচ শীর্ষ ব্যক্তিকে প্রত্যাহারের পরও কোনো ফল দেখা যায়নি। গত মঙ্গলবার ঘটনা তদন্তে পুলিশের ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সচিব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এখন লাশ পাওয়া গেছে। আলামতগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘অপহৃতদের মধ্যে ছয়জনেরই লাশ পাওয়া গেছে। যে লাশটি শনাক্ত হয়নি সেটি জাহাঙ্গীর বা লিটনের হতে পারে।’ তদন্ত কমিটির প্রধান আরো জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বিরোধসহ সব বিষয় নিয়েই তদন্ত চলছে।
লাশ উদ্ধারের পর গতকাল তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, লাশগুলো যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে শীতলক্ষ্যার তীরে সরাসরি যানবাহনে যাওয়া যায় না। কদমতলী নামের একটি এলাকা থেকে হেঁটে যেতে হয় অন্তত আধাঘণ্টা। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, অপহরণকারীরা শীতলক্ষ্যার তীরে কাঁচপুর থেকে মুন্সীগঞ্জের সীমানার এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। লাশ বা জীবিত ব্যক্তিদের শীতলক্ষ্যার পাড়ে নেওয়া হয় কাঁচপুর এলাকা দিয়ে অথবা নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জ দিয়ে ছোট নদী পার হয়ে। এসব তথ্যের সূত্র থেকে ঘটনাস্থলের আশপাশের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বন্দর থানার ওসি আখতার মোর্শেদ।
সাত পরিবারে কান্নার রোল : গতকাল বিকেলে একে একে ছয়জনের লাশ উদ্ধারের খবরে সাত অপহৃতের পরিবারে কান্নার রোল শুরু হয়। শীতলক্ষ্যার তীরে ছুটে যায় স্বজনরা। সেখানে তাদের বিলাপে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বিলাপ করে বলেন, ‘পুলিশ ওগো আগে ধরে নাই। ধরলে আমার এ সর্বনাশ হইত না। আমি নূর হোসেন, ইয়াছিন মিয়া, ইকবাল, হাসু, রাজু, আনোয়ারের বিচার চাই।’
গতকাল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের বৃষ্টিধারা আবাসিক এলাকায় অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী লাশ উদ্ধারের খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁদের চার মেয়েও বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। চন্দনের বড় মেয়ে সেজুতি সরকার কেঁদে বলেন, ‘আমার বাবার কী অপরাধ ছিল? ওরা কেন আমার বাবাকে শেষ করল?’
অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের লাশ শনাক্ত করে তাঁর বাবা আব্দুল ওয়াহাব। তিনি ছেলের হাত দেখেই পরিচয় শনাক্ত করেন। ইব্রাহিমের স্ত্রী হনুফা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘স্যারের লগে পাইছে বইলাই মাইরা ফেলল? আমরা গরিব মানুষ; এখন আমাগো কী হইব?’ স্বজনরা জানায়, ইব্রাহিম দুই বিয়ে করেন। তাঁর পাঁচ সন্তান রয়েছে। ইব্রাহিমের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়।
তাজুলের ভাই রাজু লাশ শনাক্ত করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের মা তাসলিমা বেগম কেঁদে বলেন, ‘কী অপরাধে কারা আমার এই সর্বনাশ করল?’
লাশের পরিচয় নিয়ে সংশয় : গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় শনাক্ত করা হলেও একটি লাশ অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে ছিল। রাত সাড়ে ৯টার দিকে অপহৃত যুবলীগকর্মী লিটনের ভগ্নিপতি বাবুল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দাবি করেন লাশটি লিটনেরই। হাত দেখে তিনি এমন দাবি করেছিলেন। তবে পরে বাবুলই বলেন, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। এ কারণে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত নিহত ব্যক্তি লিটন কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি কেউই।
এদিকে গতকাল রাতে হাসপাতালে উপস্থিত থেকে প্যানেল মেয়রসহ নিহতদের লাশের ময়নাতদন্ত ও হস্তান্তরের প্রক্রিয়া তদারক করেন নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। এ সময় তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেন, ‘প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই এত বড় ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন চলে গডফাদারদের কথায়। এখানকার মানুষ এদের বিচার চায়।’
সর্বশেষ জানা গেছে, মধ্যরাত পর্যন্ত নিহতদের স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছিল। নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কাসেম মো. শাহীন এ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। নজরুল ইসলামের লাশ আজ বৃহস্পতিবার সকালে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে নেওয়া হবে। সেখানে সকাল ১০টায় তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে অপহৃত হয়েছিলেন তাঁর প্রাইভেট কারের চালক জাহাঙ্গীর, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন, যুবলীগকর্মী লিটন এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম। জানা যায়, রবিবার দুপুর আড়াইটায় নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলার হাজিরা শেষে সাদা রঙের এক্স করোলা গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৯১৩৬) নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ ফিরে যাওয়ার পথে শিবু মার্কেট এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতে নজরুলের গাড়িটি গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে শালবনের পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। চন্দনের গাড়ি থেকে তাঁকে ও তাঁর গাড়িচালককে তুলে নেওয়া হয়। সোমবার রাতে ঢাকার নিকেতন থেকে তাঁর গাড়িটিও উদ্ধার করে পুলিশ।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.