বেঁচে থাকার আত্মকথা
ফাটলের ভয়ে যেতে চাইনি। তখন বেতন কাটার হুমকি দেয়। তাতেও যেতে না চাইলে লাইন চিফ হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ভবনের ভেতরে। এরপরই দোযখ খানার আযাবে জ্বলতে থাকি। ধসে পড়া রানা প্লাজার বহুতল ভবনে আটকে পড়ার ৬৫ ঘণ্টা পর উদ্ধার হন গার্মেন্টকর্মী মেরিনা। গতকাল তার আগে-পরে আরও উদ্ধার হয়েছে অন্তত ২০ নারী-পুরুষ। গতকাল সকালে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বর্ণনা করলেন সেদিনের ভয়াবহতার। বলেন, আগের দিন ফাটলের কথা শুনেই ভয়ে বেরিয়ে বাসায় যাই। ওই রাতেই ফ্লোর ইনচার্জ ফোন করে পরের দিন সকালে ভবনের সামনে থাকতে বলে। গিয়ে দেখি শ’ শ; শ্রমিকের জটলা। কেউ ভবনে ঢুকতে চাচ্ছিল না। তখন লাইন চিফ ও ফ্লোর ইনচার্জ হুমকি দিয়ে বলে, যারা ঢুকবে না তাদের পুরো মাসের বেতন কাটা যাবে। এক পর্যায়ে আমাদের হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। মেরিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, চার তলায় ওঠার পর মেশিনেও বসিনি। বলা হচ্ছিল মিটিং হবে। আর তখনই বিকট শব্দে মাথার ওপর সব কিছু ভেঙে পড়তে থাকে। কোন কিছু বোঝার আগেই অন্ধকার নেমে আসে। বুঝতে পারি বন্দি হয়ে পড়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে থাকি। চারপাশ থেকে পচা রক্তের গন্ধ আসতে থাকে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে থাকে। দীর্র্ঘ সময় পর টিফিন বক্স খুঁজে পাই। দেখি ভাত ও ভাজি পচে গেছে। বাঁচার জন্য ভাগ ভাগ করে খাই। পচা খাবারও একসময় ফুরিয়ে যায়। তখন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকি। এক পর্যায়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে অচেতন হয়ে যাই। তারপর কিছু মনে নাই। মেরিনার বাড়ি কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে। থাকতেন সাভারের শাহীবাগ এলাকায়।
গতকাল ভোর ৬টার দিকে উদ্ধার হয়েছেন শিল্পী আক্তার (২২)। তার পিতার নাম সিদ্দিকুর রহমান। বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানার পাথরঘাটা গ্রামে। এনাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন শিল্পী বলেন, বেতন কাটার ভয়ে কারখানায় যেতে বাধ্য হয়েছি। গিয়ে প্রাণই হারাতে বসেছিলাম। দয়াবানের অশেষ করুণায় জীবন ফিরে পেয়েছি। শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উদ্ধার হয়েছেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার গোনাপাড়া গ্রামের নাসিমা আক্তার (২৭)। ধসে পড়া দেয়ালের চাপে তার কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। উদ্ধারের পর তিনি বাইরে বেরিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত্যুর কূপ থেকে বেরিয়ে তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে জীবিত আছেন। তিনি ৬ তলায় চাপা পড়েছিলেন। কোমরের ওপর ছাদ ধসে পড়ে এক ইঞ্চিও নড়তে পারেননি। উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত অনাহারে ছিলেন। এনাম মেডিকেলের চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ১৫ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।