Published On: Sun, Mar 29th, 2015

বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়ার ঘরে

Share This
Tags
নিউজিল্যান্ড ১৮৩ (৪৫ ওভার)
অস্ট্রেলিয়া ১৮৬/৩ (৩৩.১ ওভার)
অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেটে জয়ী।
Australia-fans
বিশ্বকাপের ফাইনাল বলতে কি বোঝায়? ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা থাকবে। শাসরুদ্ধকর মেলা প্রহর পার হতে হবে। রোমাঞ্চের ছড়াছড়ি থাকবে গোটা ম্যাচ জুড়ে। আর রূপ রস গন্ধে মন জুড়ানো হবে সেই ফাইনাল। মুখে মুখে ফেরার মতো অনেক গল্প লুকিয়ে থাকবে এক ম্যাচের মধ্যেই। ম্যাচের এদিকটায় উঁকি দিলে যেমন দেখা মিলবে মন ভুলানো অনেক কিছু। অন্যদিক থেকে উঁকি দিলেও দেখা যাবে নানা রকমের আনন্দ বিষাদ। চরম আনন্দদায়ী এক ম্যাচই তো হতে হয় বিশ্বকাপের ফাইনালে। নইলে আর ৯০ হাজারের বেশি দর্শক কেন আসবে মেলবোর্নের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। ইতিহাস গড়া লড়াইয়ে ফাইনালের অমরত্বের পেয়ালা থাকা চাই কানায় কানায় পূর্ণ। তাহলেই না হয় একটি বিশ্বকাপ ফাইনাল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। এর কতোটা দেখা গেলো মেলবোর্নে?
অনুপস্থিত থাকলো বিশ্বকাপ ফাইনালের অনেক অনুষঙ্গ। মন জুড়ালো না। মন ভরলো না। উপভোগের ভাড়ার থাকলো খালি পড়ে। আনন্দ বিষাদের মধ্যে ডুব সাতার কাটাও হলো না। ঘুরে ফেরা হলো না রোমাঞ্চের পরতে পরতে। আসলে রোমাঞ্চটাই তো তেমন থাকলো না মোটে। বিশ্বকাপের ফাইনালটা তাই ঠিক বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো লাগলো না মোটে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের ম্যাচটা ভাবুন। ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত থাকা রোমাঞ্চের পর বলতে হয়েছিলো জিতেছে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু হারেনি তো দক্ষিণ আফ্রিকা! প্রতিকী কথাটার মধ্যেই লুকিয়ে ওই ম্যাচের মহৎ অনিশ্চয়তা পার হওয়ার গল্প। একেই না বলে ক্রিকেট।
সেই হিসেবে এবারের বিশ্বকাপের অনেক ছোটো ম্যাচের কাছেও মার খেয়ে যাওয়ার কথা এবারের ফাইনালের। মার খেয়ে যায় তো গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটার কাছেও। ওটা লো স্কোরিং ম্যাচ ছিলো। ৫ উইকেট নিয়ে বোল্ট গুটিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে। অল্প রানে। ১৫১ রানে। ৬ উইকেট নিয়ে স্টার্ক দিয়েছিলেন দাঁত ভাঙ্গা জবাব। খুব কষ্টে ১ উইকেটের জয় নিয়ে ম্যাচ শেষ করতে পেরেছিলো নিউজিল্যান্ড। বিশ্বকাপের ফাইনালে ওই ম্যাচের উত্তেজনারও সামান্য ছিটেফোটার দেখা মিললো না! আক্ষেপ!
কেমন হলো তবে ফাইনাল? রিকি পন্টিং সেদিন বললেন টাইগার উডস খেলতে নামলে অন্য প্রতিযোগীরা আগেই হেরে বসে। তাদের প্রতিযোগিতা করতে হলে দেখাতে হয় বিশেষ কিছু। একসময় অস্ট্রেলিয়াও ছিলে টাইগার উডসের মতো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামলে প্রতিযোগী দলটি খেলার আগেই হেরে বসে থাকতো। নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালও কি সেই গল্পের পুনরাবৃত্তির মতো ছিলো না!
এই গল্পে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার রোমাঞ্চই বুঝি ছিলো নিউজিল্যান্ডের মাঝে। ভাগ্য দেবী তাদের হয়তো অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিলো। মেলবোর্নে টস জেতা মানে ম্যাচের ৮০ শতাংশ প্রায় জিতে যাওয়া। ব্র্যান্ডন ম্যাককালামের দিকে দেবী ওভাবেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হলো না কি! ৩৯ রানে শীর্ষ তিন উইকেট হারালো নিউজিল্যান্ড। আবার শেষটায় ৩৩ রানে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে ৭ উইকেট হারালো নিউজিল্যান্ড। মাঝখানে ইলিয়ট ও টেলরের ১১১ রানের কাব্য গাথা না থাকলে নিউজিল্যান্ডের জন্য ১৮৩ রানও বরাদ্দ থাকে না। অতি অল্প রানেই তাদের গুটিয়ে যেতে হয়। হয়তো সেই সংগ্রহটা ইডেন পার্কের গ্রুপ পর্বের ম্যাচের সমানও হয় না। ইলিয়টের ৮৩ আর টেলরের ৪০ তাই সোনার নিক্তিতে মাপ করার মতো রান। নিউজিল্যান্ডের মান বাঁচানো রান। এর সার কথা অবশ্য একটাই। বিশ্বকাপ ফাইনালের চাপের মুখে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়েছে নিউজিল্যান্ড।
বাঁ হাতি তিন পেসারের কথাই বা ভুলে যাওয়া যায় কিভাবে। তারাই তো নিউজিল্যান্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করলেন। ফকনার আর জনসন তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন। ফকনারের স্লো বলের কীর্তি দেখা গেছে। জনসনের আগ্রাসনের জবাব তিনি নিজেই। আর কথায় কথায় উইকেট নেয়া স্টার্ক তো প্রথমেই উপড়ে নিয়েছেন বিপজ্জনক ম্যাককালামের উইকেট। এর ভেতরে স্পিনারের কথাটাও মনে করাতে হবে বলে ম্যাক্সওয়েলও দারুণ এক উইকেট শিকার করেন। তাদের সাফল্যের মাঝে জেগে ওঠে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের নিদারুণ ব্যর্থতার যাতনা। এই ব্যাটসম্যানরাই তো বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই জিতিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে। ফাইনালে এসেই কি না পথ হারালেন তারা! কি কষ্টকরই না সেই পখ ভুলে যাওয়া!
মাঝের একটি আসর ভালো যায়নি অজিদের। তার আগে ১৯৯৯, ২০০৩ ও ২০০৭ এর হ্যাটট্রিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। সে এক দিন ছিলো বটে। সেই দিনই কি বিশ্বকাপের ফাইনালে ফিরিয়ে আনলো অস্ট্রেলিয়া? ফাইনালকে দুই দলের মধ্যে অসম শক্তির লড়াই বানিয়ে দেওয়া কি সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে! এটা কি পুরণো অস্ট্রেলিয়ার জাগরণের গল্প। নাকি ঘোষণা। জানিয়ে দেয়া অস্ট্রেলিয়া আবার ফিরেছে। রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেছে রাজত্বটা চালানোর মতো করে চালাতে। সামনে যা থাকবে সব গুড়িয়ে যাবে। লেখা থাকবে শুধু অস্ট্রেলিয়ার জয়রথের গল্প। বলা হবে শুধু অস্ট্রেলিয়ার সাথে অন্যদের অসম লড়াইয়ের কথা। যেমন ছিলো আগে। অস্ট্রেলিয়া এক নম্বর। আর সবাই দুই নম্বর। আর এক ও দুইয়ের মধ্যে আকাশ ও পাতালের মতো ব্যবধান! বিশ্বকাপের একমাত্র অপরাজিত দল হিসেবে ফাইনালে ওঠা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে অন্যদের সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া অস্ট্রেলিয়ার সাথে পার্থক্যটা বিস্তর। অস্ট্রেলিয়ার সাথে লড়তে হলে হিমালয়ের উচ্চতায় নিতে হয় নিজেকে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই খেলে দুই দল। জেতে অস্ট্রেলিয়া! বিশ্বকাপের ফাইনাল কি তারই ঘোষণা!
মাঝের সময়টায় অস্ট্রেলিয়া অনেক গ্রেট খেলোয়াড়কে বিদায় বলেছে। শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই শূন্যতা ভরাট করার পথেও নতুন এক শূন্যতা দেখা দিলো। অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক (৭৪) দেশকে পঞ্চম বিশ্বকাপ জিতিয়ে বললেন বিদায়। সেই সাথে খেললেন বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতানো এক ইনিংস। অবসরের ঘোষণা দেয়ার সময় এটাই হয়তো ছিলো তার মনে। অস্ট্রেলিয়াকে হারানো রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। সেই সাতে অস্ট্রেলিয়ার ঘোষণা, তারা আবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেট বিশ্বকাটা চলবে তাদের মতো করে। হয়তো তাদের একাধিপত্যে। যেমনটা ছিলো আগে। এটা তো তাহলে বিশ্ব মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার সত্যিকারের এক নম্বর হয়ে ফেরার গল্পও বটে!

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.