Published On: Thu, Sep 3rd, 2015

বাংলাদেশ কোকেনের ট্রানজিট

Share This
Tags

Cocain

লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া, বলিভিয়া ও পেরু কোকেনের মূল উৎস। এই তিন দেশ এবং মেক্সিকো ও ব্রাজিল থেকে কোকেনের চালান আসছে বাংলাদেশে। তবে বাংলাদেশ কার্যত ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচার করা কোকেন এ রুট দিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা বা আমেরিকারই কোনো দেশে যাচ্ছে।

কোকেন পাচারের মাফিয়াচক্রে জড়িয়ে রয়েছে বলিভিয়া, পেরু, সিঙ্গাপুর, ইতালি, উরুগুয়ে, কানাডা, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন ও পাকিস্তানের নাগরিকরা। বাংলাদেশের নাগরিকরাও এতে জড়িয়ে পড়েছে। হোটেলে বসেই চালান হাতবদল করে বিদেশি নাগরিকরা। যাত্রাপথে তল্লাশি এড়াতে ব্রাজিল, ইকুয়েডর, মেক্সিকোসহ কয়েকটি দেশ থেকে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে কোকেন আনা হচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডকেও রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজন কোকেন পাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সূত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দারা এসব তথ্য পেয়েছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের ৮০ শতাংশ কোকেন উৎপাদিত হয় কলম্বিয়ায়। বাকি ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় পেরু ও বলিভিয়ায়। নির্বিঘ্নে পাচারের জন্য সেখান থেকে বাংলাদেশে কোকেন পাঠানো হয়। এখান থেকে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। আটক হওয়া এড়াতে দীর্ঘ পথ ঘুরে উৎপাদনকারী দেশের পাশের কোনো দেশেই কোকেন নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা।

কর্মকর্তারা আরো জানান, জাতিসংঘের মাদকবিরোধী সংস্থা অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএন-ওডিসি) মাদক পাচারকারী ও উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা। কয়েকটি চালান আটকের পর রুটটি এখন গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়েছে।

শাহজালালে দুই কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন পাউডারসহ আটক করা পেরুর নাগরিক জেইম বার্ডলেস গোমেজ এবং সিভিল এভিয়েশনের কর্মী সালাউদ্দিন ও আবদুল সালামকে গতকাল বুধবার বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকালই তাঁদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে।

এদিকে ডিএনসির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উদ্ধারকৃত পাউডার কোকেনই। গতকালই রিপোর্ট তদন্তকারীদের দেওয়া হয়েছে। ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘এগুলো কোকেনের নিখাদ পাউডার।’

ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) খন্দকার রাকিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কোকেনের চালানটি আটক করা হয়েছে। এটির রুট এবং কারা জড়িত তা বের করার চেষ্টা করছি আমরা।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ডিএনসির পরিদর্শক মোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল জেইমসহ তিন আসামিকে মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। কালই জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। তিনি জানান, ‘জেইম পেরুর জাতীয় ভাষা, অর্থাৎ স্প্যানিশ ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারেন না। তিনি ব্রাজিল থেকে কোকেনের প্যাকেটটি নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসেন। মার্কোস নামের এক ব্যক্তি তাঁকে চালানটি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে আফ্রিকান নাগরিক জোসেফের এটি গ্রহণ করার কথা ছিল। পাঁচ হাজার ডলারের বিনিময়ে চালানটি নিয়ে আসেন জেইম।’

সিভিল এভিয়েশনের দুই কর্মীর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তাঁরা জেইমকে সহায়তা করছিলেন। তবে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার পুরো তথ্য এখনো জানা যায়নি। আপাতত তাঁদের কাজ ছিল জেইমকে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া।

প্রাথমিক জেরায় জেইম জানান, তিনি পেরুর নাগরিক। যাত্রা শুরু করেন ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে। সেখান থেকে বাসে নিজ দেশে গিয়ে বিমানে ওঠেন। আসেন দুবাই। সেখান থেকে বাংলাদেশে। তিনি ভারতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। দুবাই এসে রুট পরিবর্তন করেন। তাঁর জন্য রাজধানীর নয়াপল্টনে ভিক্টোরিয়া হোটেলে রুম বুকিং করান জোসেফ।

আফ্রিকান নাগরিক জোসেফের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানান তদন্তকারীরা। চালান জোসেফের হাতে পৌঁছে দিলে জেইমকে পাঁচ হাজার ডলার দেবেন বলে চুক্তি করেছিলেন মার্কোস। তিনি ব্রাজিল না পেরুর নাগরিক নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁরা।

ডিএনসি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত এপ্রিলে মেক্সিকোয় বাংলাদেশ দূতাবাস মারফত ডিএনসি জানতে পারে একজন বলিভিয়ান ও দুই বাংলাদেশি কোকেন পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে আমদানি পণ্যের তালিকা জানতে চায় অধিদপ্তর। এরই মধ্যে গত ৮ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্য তেলের মধ্যে তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে। যেটি এসেছিল বলিভিয়া থেকে।

২০১৩ সালের ২ জুন পাওয়া গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ১১ জুন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের হোটেল লা ভিঞ্চি থেকে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয় পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিতারকে। এটিই এখন পর্যন্ত আটক করা কোকেন পাউডারের সবচেয়ে বড় চালান। পাবলো এখন কারাগারে আছেন। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, কোকেনগুলো পাকিস্তান হয়ে ইউরোপের একটি দেশে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পেরুর রাজধানী লিমা থেকে তিনি বাসে করে ইকুয়েডর যান। সেখান বিমানে করে পানামা হয়ে ব্রাজিল পৌঁছান। সেখান থেকে বিমানে করে দুবাই হয়ে ঢাকায় আসেন। তল্লাশি এড়াতে তিনি ইকুয়েডর গিয়েছিলেন। ঢাকার হোটেল থেকে এক বাংলাদেশি নারীর চালানটি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালে ভেনিজুয়েলায় আটককৃত আড়াই কেজি কোকেনের চালান বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। ২০১১ সালে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার পুলিশ বাংলাদেশ থেকে ডাকে পাঠানো ৮০০ গ্রাম কোকেনের প্যাকেট আটক করে। ২০০৯ সালে ব্যাংকক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সোয়া কেজি কোকেনের চালান আটক করে থাই পুলিশ। ২০১২ সালের ১৬ মে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেল থেকে আইকেমি চিজোবা বেতসি নামের এক নাইজেরিয়ান নারীকে আটকের পর তাঁর পেট থেকে ৪৫০ গ্রাম কোকেন বের করা হয়। তিনি ক্যামেরুন থেকে বাংলাদেশে আরো তিনবার চালান নিয়ে আসেন।

ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, ‘দেশে কোকেনের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। মূলত বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

 

সুত্র – কালের কণ্ঠ

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.