প্রতিদিন ৫০ লাখ ইয়াবা হাতবদল
‘ভয়ংকর’ মাদক ইয়াবার দেশব্যাপী আগ্রাসন ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বাড়ছে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা। রাজধানীসহ সারা দেশে দিনে ৫০ লাখ ইয়াবা বড়ি হাতবদল হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আসছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে। কক্সবাজার, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকা হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার অন্তত ৩৭টি ল্যাবে (কারখানা) এসব ইয়াবা তৈরির পর তা টেকনাফের ১১ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে দেশে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মাদক চোরাচালানের বেশ কিছু উদ্বেগজনক তথ্য পেয়ে বাংলাদেশ সরকার ইয়াবার আগ্রাসন রোধে মিয়ানমারের সহায়তা চাইছে। চলছে সফর বিনিময়, চিঠির আদান-প্রদান। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৫ মে মিয়ানমারের নরকোটিকস বিভাগের প্রধানসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল আসছে। ওই দিনই রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বসছে দুই দিনব্যাপী দ্বিপক্ষীয় বৈঠক।
ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠেয় এবারের বৈঠকটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈঠকে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধে মিয়ানমারের সর্বাত্মক সহায়তা চাওয়া হবে। প্রতিনিধিদলের কাছে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ইয়াবা চোরাচালানের রুট, ইয়াবার কারবারি ও কারখানার তথ্য হস্তান্তর করা হবে। ল্যাবগুলো ধ্বংস করা এবং সরবরাহ বন্ধ করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাবও রাখা হবে মিয়ানমারের কাছে।
জানতে চাইলে ডিএনসি মহাপরিচালক (ডিজি) বজলুর রহমান বলেন, ‘বৈঠকে আমরা বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরব। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কও উন্নত হবে বলে আশা করছি। বিশেষ করে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘মাদক-সংক্রান্ত বিষয়ে ১৯৯৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দেশের একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। এর ফলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের কারখানার তালিকা, রুটসহ সার্বিক বিষয়ে জানানো হয়। আলোচনা ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে।’
ডিএনসি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সঙ্গে মাদকদ্রব্য-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি হয় ২০১১ সালের ১৫ ও ১৬ নভেম্বর ইয়াঙ্গুনে। ওই বৈঠকে ইয়াবার ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের সহায়তা চায়। গত ১২ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিএনসির ডিজি বজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল মিয়ানমার সফর করে। সেখানে একটি যৌথ সভায় দ্বিতীয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাবের পর সম্মতি মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার পুলিশের নারকোটিক্স উইং প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাই উইনসহ চার সদস্যের দল আগামী ৫ মে ভোরে ঢাকায় আসছে। দুই দিনব্যাপী বৈঠকে বাংলাদেশের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট দলের নেতৃত্ব দেবেন ডিএনসির ডিজি বজলুর রহমান।
ডিএনসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা আসছে। লাখ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় চালানের পরিমাণ বেড়েছে। এসব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিষয়টি আমরা তাদের বোঝানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের কারখানায় বৈধ ওষুধ তৈরির মতোই লাখ লাখ পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। এমন ৩৭টি কারখানা ও কারবারির তথ্য আগেই পাওয়া গেছে। ওই তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। আমরা মূলত তিনটি বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি- ল্যাব ধ্বংস করা, পাচার বন্ধ করা ও তথ্য আদান-প্রদান।’
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব কষে দেখা গেছে, দেশে প্রায় ২৫ লাখ ইয়াবাসেবী রয়েছে। আর তাতে করে দিনে প্রায় ৫০ লাখ ইয়াবার বাজার তৈরি হয়ে গেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের গত মাস পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে পাঁচটি সংস্থা। এক বছর ধরে লাখ লাখ পিসের চালান উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এক বছরে সারা দেশে ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫২৮ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা থেকেই উদ্ধার করা হয় প্রায় ১৮ লাখ পিস ইয়াবা। নদী, সাগর ও সড়কপথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরং, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়া, জলিলেরদিয়া, লেদা, আলীখালি, হৃীলাসহ অন্তত ১১টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। টেকনাফ থেকে নাফ নদী পার হলেই ওপারে মিয়ানমারের মংডু এলাকা। সেখান থেকেই বেশি আসে ইয়াবার চালান। বাংলাদেশ সীমান্তের রাখাইন ও শিন প্রদেশের ১৫টি স্থানে ১০ কিলোমিটার এলাকায় অন্তত ৩৭টি ল্যাব বা ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে।