Published On: Fri, Jun 27th, 2014

তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বাড়ছে আসক্তি

Share This
Tags

shisha03রাত তখন মাত্র এগারোটা। গুলশান লিংক রোড ধরে আড়ংয়ের সামনে যেতেই চোখে পড়ল জটলা। দুই বয়ফ্রেন্ড ধরাধরি করে মীরা নামের এক অষ্টাদশী অত্যাধুনিক তরুণীকে রিক্সায় তুলছিল।

মীরা বলছে, আমি যাব না। তোমরা আমাকে এখানে রেখে চলে যাও। সে উন্মাদের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। পথচারী তাকে দেখে থেমে যায়। ‘মীরা-সিনক্রিয়েট করো না।’ কিন্তু মীরা কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছিল না। মান-সম্মানের ভয়ে তারা রিক্সা নিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে। কী হয়েছে মেয়েটির?

প্রশ্ন করা হলে, ফুয়াং ক্লাবের এক দারোয়ান বলেন, কী এক বিয়ার বের হয়েছে- একটা খাইলেই কাফি। ওটা খেয়েই এই দশা।

কী বিয়ার খেতে আসে এখানে? জবাবে ফুয়াং ক্লাব থেকে বের হওয়া আরেক যুবক জানান, এটা স্ট্রং বিয়ার। ঢাকায় এ্যাভেলেবল। দাম পাঁচ শ’ টাকা। একটা খাইলেই আর লাগে না! রাজধানীতে তরুণ-তরুণীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এ বিয়ার। বাণিজ্যিকভাবে চালানো বারগুলোতেও এখন এসব বিয়ারের ব্যবসা দারুণ রমরমা।

থানা পুলিশ, নারকোটিক্স, শুল্ক বিভাগ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলছে স্ট্রং বিয়ারের দাপট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও শুল্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ বিয়ারের নামই জীবনে কেউ শোনেননি বলে জানিয়েছেন।

এ সম্পর্কে খোঁজ নিতে ফুয়াং ক্লাবের ভেতর গিয়ে দেখা গেল অন্য দৃশ্য।

ভেতরে চলছিল ডি-জে পার্টি। তরুণ-তরুণীদের উদ্দ্যম নৃত্য। ধূমপানের ধোঁয়াশা। চলে সীসার হুক্কা। সঙ্গে স্ট্রং বিয়ারের উন্মাদনা। ডামবার্গার, এটলাস, হলান্ডিয়া ব্যাভারিয়া ক্লিকার্স। দাম সাড়ে চার শ’ থেকে ছয় শ’ টাকা। ওয়েস্ট্রেকে অর্ডার দিতেই নিয়ে আসে একটা হলান্ডিয়া। ক্যানে লেখা এ্যালকোহলের ভলিয়ম ১০ পার্সেন্ট। আবার অর্ডার দিয়ে আনা হয় ডামবার্গার। এটাতে এ্যালকোহলের ভলিয়ম ১৪ পার্সেন্ট।

হাই-ভলিয়মের এসব বিয়ার তরুণ-তরুণীদের খুবই পছন্দের। এসবে নেশা যেমন হয় তীব্র, তেমনি লাগেও অল্প। যেখানে প্রতিটি তিন শ’ টাকা দামের হ্যানিকেন বিয়ার তিনটা খেলেও নেশা ততটা হয় না, সেখানে হলান্ডিয়া বা ডামবার্গার একটা খেলেই ঢের আর দুটো খেলে তো কথাই নেই, স্বাভাবিক হেঁটে বাসায় যাওয়া যায় না। তখন মীরার মতো উন্মত্ত হয়ে আবোল-তাবোল বলতে হয়। অনেকে বমি করতে করতে রাস্তায় পড়ে যায়। মাতলামি করে রাস্তাঘাটে গণউৎপাত ঘটায়।

গত সপ্তাহে এ রকম এক অপ্রীতিকর ঘটনা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। রবি নামে ১৬ বছরের এক পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে হঠাৎ শূটিং ক্লাবের সামনে দিয়ে চলা একটা প্রাইভেটকারে বিয়ারের বোতল দিয়ে ঢিল ছোড়ে। অবাক হয়ে চালক গাড়ি থামিয়ে ওই যুবককে ধরার চেষ্টা করে। পারেনি।

একপর্যায়ে জনতার সাহায্যে তাকে ধরার পর পুলিশ আসে, বিষয়টি থানায় গড়ানোর পর তার স্টোমাক ওয়াশ করা হলে মেলে উচ্চমাত্রার এ্যালকোহল আর এতেই যত বিপত্তি।

কারা আনছে এসব বিয়ার? : ঢাকায় বৈধভাবে উচ্চমাত্রার এ্যালকোহল আমদানির কোন সুযোগ নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, বিশ্বস্বীকৃত মানসম্মত বিয়ারে এ্যালকোহলের ভলিয়ম ৫ শতাংশ। এর বেশি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাহলে সেটাকে আর বিয়ার বলা যাবে না। তখন সেটাকে বলতে হার্ডড্রিংকস। সেক্ষেত্রে স্ট্রং বিয়ার যারা আনছে তারা অন্যায় করছে।

মাদক রুলস অমান্য করছে। এটা অপরাধ। ঢাকা মেট্রো মাদকদ্রব্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমুল কবীর বলেন, আমরা এখনও এ ধরনের বিয়ার কোন বারে বেচাকেনা করছে কিনা, জানি না।

তবে খোঁজ নিয়ে যদি এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের বিয়ার আমদানি বা বিক্রির সুযোগ নেই। হতে পারে এ সব বিয়ার চোরাইপথে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ বারে এসব বিয়ার পাওয়া যায়। সোমবার ইস্কাটনের গোল্ডেন ড্রাগনে গিয়ে চাওয়া মাত্রই ওয়েস্ট্রেস এ প্রতিনিধির হাতে এনে দেন একটা ডামবার্গার। দাম পাঁচ শ’ টাকা। আগে টাকা পরিশোধ। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর একটা বিয়ার এনে হাতে দেয়।

ওয়েস্ট্রেস জানান, স্ট্রং বিয়ারের মধ্যে ঢাকায় বেশি পাওয়া যায় হলান্ডিয়া। প্রায় বারেই মিলছে এটা। ৩৩০ মিলিমিটারের এ বিয়ারের দাম রাখা হয় সাড়ে তিন শ’ টাকা। ব্যাভারিয়াও একই রকম। এতে এ্যালকোহলের ভলিয়ম ৮ শতাংশ।

রাজস্ববোর্ড সূত্রে জানা যায়, যারা মদ-বিয়ারের বৈধ আমদানিকারক, তারাই মূলত অবৈধ পন্থায় এসব মাদক আনছে। ডেনমার্ক, হলান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসব মাদক আসে সিঙ্গাপুর হয়ে। বেশিরভাগই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কমলাপুর আইসিডি হয়ে খালাস। কখনও মিথ্যা পণ্য ঘোষণায়, কখনও বিয়ারের ব্র্যান্ড পরিবর্তন করে জালিয়াতির আশ্রয়ে এসব আনা হচ্ছে। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপুল পরিমাণ স্ট্রং বিয়ারসহ অন্যান্য বিদেশী মদের চালান আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ।

এ ব্যাপারে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, আটক কন্টেনারে কোটি কোটি টাকার মদ-বিয়ার রয়েছে। এটার তদন্ত চলছে। সিঙ্গাপুরের যে কোম্পানির কাছ থেকে এসব মাল জাহাজে ওঠানো হয় সেখানেও তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, বৈধ পথে এ ধরনের উচ্চ এ্যালকোহলের বিয়ার দেশে আনার কোন সুযোগ নেই। যারাই আনছে হয় জালিয়াতি নয়ত চোরাচালানের মাধ্যমে। তবে ওয়ার হাউস ও ডিউটি ফ্রি শপের জন্য আনা মালও অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে বাইরে। বারগুলোও চড়া লাভের আশায় এসব বিয়ার বিক্রিতেই আগ্রহী বেশি।

ঢাকায় সাধারণত মদ-বিয়ার আনে কয়েকটি ওয়ারহাউস। বিশ্বনন্দিত, হ্যানিকেন, ফস্টার, টারবার্গ, টাইগার, বিয়ারের ক্যানে এ্যালকোহলের ভলিয়ম লেখা থাকে ৫ পার্সেন্ট। দেশীয় ফাইভ স্টার হোটেল, অনুমোদনপ্রাপ্ত মোটেল ও রিসোর্টগুলোতে সাধারণত এসব বিয়ার বৈধভাবে বিক্রি হয়। ওয়ারহাউসগুলো এসব বিয়ার আমদানি করলেও ইদানীং স্ট্রং বিয়ারের দিকে ঝুঁকছে।

গুলশানের সাবের ট্রেডার্স, সানবীম ট্রেডার্স, সারবান, টসবং নামের প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর থেকে এসব স্ট্রং বিয়ার অবৈধ পন্থায় আমদানি করছে।

এ ছাড়া আরও প্রায় দশটি অনুমোদনপ্রাপ্ত বিদেশী প্রতিষ্ঠান ঢাকায় সরাসরি তাদের দেশ থেকে মদ-বিয়ার আমদানি করছে। তারা নিজেদের প্রয়োজন ও চাহিদার বেশি বিয়ার এনে খোলা বাজার ও বারগুলোর কাছে বিক্রি করছে। সম্প্রতি এমন একটি চালান কমলাপুর আইসিডিতে আটক করা হয়।

এ ধরনের উচ্চমাত্রার বিয়ারের উৎসস্থল সম্পর্কে শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আমদানির জন্য কটা ব্র্যান্ডকে অনুমতি দেয়া আছে সেগুলো হচ্ছে-হ্যানিকেন, ফস্টার ও টাইগার। এর বাইরে যত বিয়ার দেশে আছে সবই অনুমোদনহীন। এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন এসব কোন্ প্রতিষ্ঠান আনছে সেটাও তদন্তের দাবি রাখে।

একটি বারের মালিক জানান, বারগুলোতে স্ট্রং বিয়ারের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। দাম বেশি হলেও ছেলেমেয়েরা এটাই তাদের ফেবারিট ড্রিংকস বলে মনে করছে।

কতটা ক্ষতিকর? : এসব বিয়ারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানা যায়, যে কোন উচ্চমাত্রার বিয়ার বা এ্যালকোহলই শরীরের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে লিভার কিডনিসহ মস্তিষ্কের বৈকল্য দেখা দিতে পারে।

ডেনমার্কে উৎপাদিত ডামবার্গার নামের স্ট্রং বিয়ারের উৎপাদন প্রণালীতে দেখা যায়, এতে যে ধরনের এ্যালকোহল রয়েছে তা কেবল শীতপ্রধান দেশের মানুষ ও প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য।

শীতে কাবু হয়ে পড়া ঘোড়া, হাতি ও কুকুর যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন তাদের উত্তেজিত করার জন্য ডামবার্গার খাওয়ানো হয়। কয়েকটা ডামবার্গার খাওয়ালেই একটা ঘোড়া উচ্ছ্বাসে লাফ দিয়ে ওঠে।

একইভাবে হাতিও ফিরে পায় চলচ্ছশক্তি। শীত কিংবা অন্যকোন কারণে নিস্তেজ হওয়া প্রাণীর প্রণোদনা জাগাতে এসব এ্যালকোহল পান করানো হয়। সেটাই যখন মানুষ পান করে, তখন তার মস্তিষ্ক কতটা স্বাভাবিক থাকে?

নেদারল্যান্ডসের হলান্ডিয়া ও বেভারিয়া একই প্রকৃতির।

মাদক বিভাগের সহকারী পরিচালক নাজমুল কবির জানান, এ ধরনের উচ্চমাত্রার এ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন মানুষের সেন্ট্রাল নার্ভ সিস্টেম খুব উত্তেজক হয়ে ওঠে এবং শরীরে প্রচণ্ড শক্তি বেড়ে যায়। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পর্যন্ত মাদকসেবী এ ধরনের শক্তি ও উত্তেজনা অনুভব করে। কিন্তু যখন নেশা কেটে যায়, তখন ততটা দ্রুতগতিতেই তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া শিথিল হয়ে আসে।

এতে মস্তিষ্কের উত্তেজিত সেলগুলো শুকিয়ে বা মরে যায়। যার পরিণামে মাদকসেবীর মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটার মতো অবস্থা হতে পারে। একইভাবে কিডনি ও যকৃতেরও ক্ষতি হতে পারে।

মদ-বিয়ার আমদানির লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ শুল্ক বিভাগের বন্ডেড শাখার কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, বর্তমানের দেশে ৬টি ওয়ারহাউস ও ছয়টি ডিউটি ফ্রি শপ প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে এসব মদ-বিয়ার আমদানি করছে।

এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সামাজিক ক্লাব, বার রেস্টুরেন্ট ও অভিজাত হোটেল সরাসরি বিদেশী মদ-বিয়ার আমদানি করে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন ইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও বিদেশী হোটেল-রিসোর্টে জাতীয় এ্যালকোহল আমদানি করে।

এসব প্রতিষ্ঠান রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে চাহিদামাফিক মদ-বিয়ার আমদানি করে। আমদানির পর কারা কারা এসবের ভোক্তা, কাদের কাছে এসব বিক্রি করা যাবে, কাদের কাছে যাবে না, সেটাও মনিটর করা হয়।

মাল আমদানির সময় চট্টগ্রামের বন্দরে খালাসের সময় বন্ড বিভাগের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকে। কোন্ কোম্পানি কী পরিমাণ এ্যালকোহল আমদানি করছে সেটা বন্দরেই তদারকি করা হয়। তারপর সে মাল ওয়ারহাউসে নেয়ার পর সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়।

যেমন ওয়ারহাউসের কাছ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত দেশী-বিদেশী বিশেষ প্রিভিলেজডপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ এ্যালকোহল সংগ্রহ করতে পারে। একইভাবে বিদেশী পাসপোর্টধারী নাগরিকরা ডিউটি ফ্রি শপ থেকে একটি এ্যালকোহল সংগ্রহ করতে পারে। এর বাইরে আর কারও কাছে মদবিয়ার বিক্রির কোন সুযোগ নেই।

কেউ যদি করে থাকে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের কোন অভিযোগও বন্ড শাখার নজরে নেই। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, মদ-বিয়ার আমদানির অনুমতি নিতে হয় সরকারের অনেক সংস্থার কাছ থেকে। পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র ও রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদনের পরেই বন্ড কর্তৃপক্ষ লাইসেন্স প্রদান করে থাকেন। আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও আলাদা বন্ড শাখা রয়েছে। তাদের কাছ থেকেও অনুমতি লাগে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে, কারা আনছে এসব উচ্চমাত্রার বিয়ার? জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য অধিদফতর বলছে, আগে এর অনুমতি লাগত। এখন বিদেশ থেকে আমদানির জন্য মূল অনুমতি নিতে হয় বন্ড শাখা থেকে। মাদকদ্রব্য শুধু মাদক চোরাচালান ও অপব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করে। প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়।

এ ব্যাপারে রাজধানীর যেসব বারে এ ধরনের স্ট্রং বিয়ার বিক্রি করে তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় ভিন্ন তথ্য। নিউ ইস্কাটনের গোল্ডেন ড্রাগনে সোমবার রাত আটটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যুবকরা দেদার ডামবার্গার বিয়ার খাচ্ছে। পাঁচ শ’ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে।

এখানে আরও মিলছে হলান্ডিয়া, কালর্সবার্গ, ক্লিকার্স, বেভারিয়া ও এটলাসের মতো স্ট্রং বিয়ার।

হলান্ডিয়ায় বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে দেখা যায় তাতে ১২ পার্সেন্ট এ্যালকোহল রয়েছে। একইভাবে ফার্মগেটের রেড বাটন বারে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও বিক্রি করা হচ্ছে ক্লিকার্স নামের একটি বিয়ার-যাতে লেখা ১৫ পার্সেন্ট এ্যালকোহল, দাম ছয় শ’ টাকা।

এখানকার এক ওয়েট্রেস জানান, বার হলেও এ জাতীয় স্ট্রং বিয়ার বিক্রির কোন অনুমোদন নেই। এগুলো বিক্রিতেও রয়েছে কড়াকড়ি। অন্যান্য সাধারণ বিয়ার রাখা হয় বারের কাউন্টারেই। কিন্তু উচ্চ এ্যালকোহলের বিয়ার রাখা হয় বার কিংবা অন্য কোন গুপ্তস্থানে। আগে দাম পরিশোধ করতে হয়। তারপর বসতে হয় কয়েক মিনিট।

এতে বোঝা যায়, বার থেকে দূরের কোন নিরাপদ স্থানে এসব লুকিয়ে রাখা হয়। শুধু যে বার নয়, বিমানবন্দরের কয়েকটি ডিউটি ফ্রি শপেও মিলছে এসব উচ্চমাত্রার বিয়ার।

মঙ্গলবার সকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে সবচেয়ে বড় ডিউটি ফ্রি শপ সারবানে গিয়ে দেখা যায়, কালর্সবার্গ নামের স্ট্র বিয়ার তারা আমদানি করছে।

একই পদ্ধতিতে মহাখালীর হোটেল জাকারিয়া, রুচিতা, গুলশানের লা ডিপ্লোম্যাট ও ক্যাপিটাল ক্লাবে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে এ ধরনের স্ট্রং বিয়ার।

মাদকদ্রব্য অধিফতরের গুলশান জোনের পরিদর্শক কামরুল ইসলাম জানান, এ ধরনের কোন বিয়ার সম্পর্কে কারো কাছ থেকে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে কোন বার যদি এসব বিয়ার আনে কিংবা বিক্রি করে সেটা অবৈধ। পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রকাশ্যে এ ধরনের ব্যবসা চালানোর কোন খবর জানা নেই বলে জানিয়েছে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ শুল্ক বিভাগ, বন্ড কমিশনারেট, মাদক ও রাজস্ব বিভাগ।

কমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, বন্ড বিভাগ শুধু মদ-বিয়ার আনার জন্য লাইসেন্স প্রদান করে। এতে কী ধরনের বিয়ার বা মদ আনা হবে এটা দেখার দায়িত্ব বন্ড বিভাগের নয়। এটা দেখবে বন্দরের শুল্ক বিভাগ। যেখানে আমদানি পণ্য খালাস করা হয়। বন্ড ও শুল্ক বিভাগের দায়িত্ব শুধু অনুমোদিত পরিমাণের অতিরিক্ত কোন মাদক আনা হয়েছে কিনা, সেটা দেখা। বিয়ারের উচ্চ ভলিয়মের এ্যালকোহল আছে কিনা নেই, এটা বৈধ কি অবৈধ সেটা দেখার দায়িত্ব মাদক বিভাগের।

ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সহকারী পরিচালক নাজমুল কবির বলেন, এক সময় মাদক আমদানির অনুুমোদনসহ অন্যান্য নজরদারির বিষয়ে মাদক বিভাগের একক কর্তৃত্ব ছিল। কিন্তু এতে বাদ সাধে শুল্ক বিভাগ। এ নিয়ে শুল্ক বিভাগ ২০০১ সালে হাইকোর্টের একটি রিট পিটিশন দায়ের করে এবং মাদক আমদানির একক কর্তৃত্ব শুল্ক বিভাগের কাছে ন্যস্ত করার আদেশ পায়। এ আদেশের পর থেকে মাদক বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে যায়। এখন কে, কী ধরনের মাদকদ্রব্য আমদানি করছে কোথায়, কার কাছে বিক্রি করছে সেটা নজরদারি বা তদারকি করার কোন দায়িত্ব মাদকের হাতে নেই।

এ আদেশের বলেই শুল্ক বিভাগ এককভাবে সব করছে। গত একযুগ ধরে একের পর এক রিট করতে করতে এখন পর্যন্ত মোট ১৯টি রিট করে শুল্ক বিভাগ। এক রিট আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আরেকটি আদেশ চেয়ে রিট করে। এভাবেই চলছে। এসব আইনী লড়াইয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ মাদক বিভাগ কিছু করতে পারছে না।

স্ট্রং বিয়ার সম্পর্কে তিনি বলেন, আসলে কোন ধরনের বিয়ার আমদানি করা যাবে কী যাবে না তার কোন নীতিমালা নেই। ফলে আইনের এই ফাঁক ফোকরের সুযোগে হয়ত এ ধরনের বিয়ার আমদানি হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য বিভাগ একটি নারকোটিক্স বিধিমালা প্রণয়ন করার জন্য কাজ করছে। এতে লেখা থাকবে বিয়ারে কত পার্সেন্ট এ্যালকোহল থাকতে পারবে। পাঁচ শতাংশের বেশি হলে সেটাকে আর বিয়ার বলা হবে না।

[লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক জনকণ্ঠ।]

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.