‘ডেমু’ কমিউটার ট্রেন এ মাসেই বাংলাদেশ এ চালু হবে
চলতি মাসেই রেলের বহরে যুক্ত হচ্ছে নতুন ধরনের আধুনিক কমিউটার ট্রেন ‘ডেমু’। প্রাথমিকভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এ ট্রেনের যাত্রা শুরু হবে। দুই দিকে ইঞ্জিন থাকা ও অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির হওয়ায় ডেমুর কিছু সুবিধা রয়েছে। আবার এর যাত্রী ধারণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম বলে যাত্রীর চাপ সামলানো নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে পরিকল্পনায় গলদ থাকার অভিযোগ করেছেন।
ডেমু (DEMU) হচ্ছে ‘ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট’-এর সংক্ষিপ্ত নাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এ ট্রেনের উদ্বোধন করার কথা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০ সেট ডেমু দিয়ে পর্যায়ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ মিটারগেজ রেললাইন রয়েছে—এমন এলাকায় কমিউটার ট্রেন চালু করা হবে। এ দেশে নতুন এবং দেখতে আকর্ষণীয় বলে এ ট্রেন চালু করাকে সরকার একটি অর্জন হিসেবে দেখাতে চায়।
প্রতি সেট ডেমুতে দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে একটি বগি থাকে। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিনেও কয়েকজন যাত্রী বহন করা যাবে। দুই দিকে ইঞ্জিন থাকায় গন্তব্যে পৌঁছে ইঞ্জিন ঘোরানোর ঝামেলা পোহাতে হবে না। দেশে প্রচলিত ট্রেনের ক্ষেত্রে যাত্রী ওঠানো-নামানো ও ইঞ্জিন ঘোরানোর জন্য ২০ মিনিট বরাদ্দ রাখা হয়। ডেমুতে ১০ মিনিট সময় কম লাগবে। এ ট্রেন তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিরও। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। তবে লাইনের অবস্থা, যত্রতত্র রেলক্রসিং এবং স্টেশনগুলোর কম দূরত্বের কারণে বাস্তবে এটি বিদ্যমান কমিউটার ট্রেনের চেয়ে বেশি গতিতে চালানো সম্ভব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ট্রেন কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া ৪০, গেন্ডারিয়া থেকে চাষাঢ়া ৫৫ এবং চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার গতিতে চলে। অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও এ নতুন ট্রেন সার্ভিস নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বড় প্রশ্নটি হচ্ছে, যাত্রী ধারণক্ষমতা নিয়ে। এ ট্রেনগুলো যে পথে চলবে, সেখানে বর্তমানের কমিউটার বা লোকাল ট্রেন পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু বিদ্যমান ট্রেনের তুলনায় ডেমুর যাত্রী ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় চাহিদা মেটানো যাবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথের ওপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিদ্যমান কমিউটার ট্রেনগুলো কর্মদিবসে প্রতি যাত্রায় গড়ে দেড় হাজার যাত্রী পরিবহন করে। অন্যদিকে ডেমুর একটিমাত্র বগিতে আসন আছে ১৪৯টি। দাঁড়িয়ে যেতে পারবে ১৫১ জন। সব মিলিয়ে যেতে পারবে ৩০০ যাত্রী। দুটি জোড়া দিলে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা হবে ৬০০।
কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, ডেমুর ইঞ্জিন বা বগি সাধারণ ট্রেনের ইঞ্জিন বা বগির তুলনায় কিছুটা হালকা এবং কম টেকসই। এ কারণে তা বাংলাদেশের পরিবেশে কতটা উপযুক্ত হবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। যাত্রীর ভিড় খুব বেশি হলে এ ট্রেন অচল হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। ডেমু চালানোর উপযোগী অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ডেমুর বয়স ধরা হয়েছে ২৫ বছর। যেখানে কি না বর্তমানে চালু ৫০ বছর পর্যন্ত পুরোনো ইঞ্জিন ও ৩০ থেকে ৪০ বছরের পুরোনো বগিগুলো এখনো চলছে।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, নতুন এ ট্রেনে গন্তব্যে পৌঁছে ইঞ্জিন বদলের ঝামেলা নেই। সে জন্য দ্রুত ফিরতি যাত্রায় যেতে পারবে। ধারণক্ষমতা কম হলেও দ্রুত চলাচলের মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
পরিকল্পনার ভুল?: রেল সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শহরের চারপাশে, চট্টগ্রাম-ফেনী, লাকসাম-চাঁদপুর, লাকসাম-কুমিল্লা, লাকসাম-ফেনী, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-আখাউড়াসহ কয়েকটি পথে ডেমু চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব পথে এখন বেশ কয়েকটি কমিউটার ও লোকাল ট্রেন চলে। সব ট্রেনই যাত্রীবোঝাই থাকে। ফলে এক যাত্রায় (ট্রিপ) এক সেট ডেমু দিয়ে যাত্রীদের চাহিদা মেটানো যাবে না। এ কারণে দুটি ডেমু জোড়া দিয়ে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে করে বাড়তি দুটি ইঞ্জিন কোনো কাজে আসবে না। কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন বগির ডেমু রয়েছে। কিন্তু এখানে রেল কর্তৃপক্ষ সেটা করছে না। একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রকল্প তৈরির সময় তিন বগির সেট কেনার পরামর্শ দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি।
২০ সেট ডেমু প্রকল্পের পরিচালক সাইদুর রহমান দাবি করেন, বাংলাদেশের রেললাইনের ভার বহনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও সেতুগুলো পুরোনো হওয়ার কারণে বেশি বগির ডেমু করা সম্ভব হয়নি।
অবকাঠামো নেই: দেশের সাধারণ ট্রেনের তুলনায় ডেমুর প্রবেশদ্বার ছয় ইঞ্চি উঁচুতে। এ কারণে কমলাপুর বাদে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথের সব স্টেশনে যাত্রীদের উঠতে সমস্যা হবে। ডেমুর দরজাগুলোও দেশে প্রচলিত ট্রেনের তুলনায় কম চওড়া। দরজার উচ্চতার সমস্যা দূর করতে স্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্মই সাময়িকভাবে উঁচু করার পরিকল্পনা নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
ইতিমধ্যে দুই সেট ডেমু দেশে এসেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়। চলতি মাসেই আরও ছয় সেট আসার কথা। আগামী জুন মাসের মধ্যে ২০টি সেটের সবই চলে আসবে বলে আশা করছেন রেলের কর্মকর্তারা।
২০ সেট ডেমু আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৪২৬ কোটি টাকা। ভ্যাট ও কর বাদে প্রতি সেট ডেমুর দাম পড়বে ২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পুরো টাকাই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে খরচ করা হচ্ছে। রেলের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ টাকা দিয়ে দূরপাল্লার পথে ট্রেন চালানোর জন্য অন্তত চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ও ১০০ কোচ কেনা যেত। তা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব ছিল। – – – সুত্র প্রথম আলো