ওরা যারা অ্যাপ ডেভোলপার
আইটিউনস, গুগল প্লের মতো মার্কেটপ্লেসে এখন হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে আমাদের দেশের ডেভেলপারের তৈরি অ্যাপ। এগুলোর কোনো কোনোটা তো বিক্রির দিক থেকে আছে ভালো অবস্থানেও। সেরকম সাতজন অ্যাপ ডেভোলপারদের নিয়েই আজকে ঢাকাবিডি২৪ এর বিশেষ প্রতিবেদন।
বাবা, মা এবং মামাদের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ানোর। আর শফিউল আলম বিপ্লবের দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল ‘কম্পিউটার’-এর প্রতি। ভর্তি হলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পিউটার’ বিভাগে। দ্বিতীয় বর্ষে কাজ শুরু করলেন জাভা নিয়ে। সম্মান শেষ করে ঢাকায় এসে প্রথমে একটি কলসেন্টার ও পরে একটি ফার্মে অ্যানড্রয়েড ডেভেলপার হিসেবে চাকরি পেলেন। ২০১০ সালে ওডেস্কে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে চাকরির জন্য আবেদন করলেন। ক্লায়েন্টও সাড়া দিল। ব্যস, সেই থেকে ফ্রিল্যান্স অ্যাপ ডেভেলপার হিসেবে শুরু। পরে ‘ড্রয়েড বাংলাদেশ’ নামে একটি টিম গঠন করে কাজ শুরু করেন। একই বছর কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি লিমিটেড কম্পানি। ২০১২ সালে এ কম্পানির কর্মীসংখ্যা দাঁড়াল ২২ জনে। প্রথম বছরেই আয় হলো এক কোটিরও বেশি। বেসিস থেকে পেলেন ‘বর্ষসেরা ফ্রিল্যান্সার’ পুরস্কারও। ২০১৩ সালে এসে খুললেন আরেক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডভান্সড অ্যাপ বাংলাদেশ’। অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ নানা দেশে নিয়মিত ক্লায়েন্ট রয়েছে বিপ্লব ও তাঁর কম্পানির।
পার্থ সারথি কর
সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক পার্থ সারথি কর এখন সফল ফ্রিল্যান্স অ্যাপ ডেভেলপার। পড়াশোনার শেষে ভাবলেন, এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করবেন যেখানে নতুন কিছু শেখা যাবে এবং তা ভবিষ্যতে জনপ্রিয়ও হবে। সে তাগিদেই একটি মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট কম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন। তিন মাস কাজ করার পর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নিজেই ফ্রিল্যান্স ডেভেলপার হিসেবে মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করেন। সেখানে কিছু ভালো ক্লায়েন্টও পেয়ে যান। এরাই এখন তাঁর নিয়মিত ক্লায়েন্ট। এখন মূলত অ্যানড্রয়েড প্ল্যাটফর্মেই কাজ করছেন। তৈরি করা অ্যাপসগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ইন্টারনেট রেডিও প্লেয়ার, জিওলোকশন ইত্যাদি সম্পর্কিত। ভারত সরকারের ভ্রমণবিষয়ক একটি অ্যাপ্লিকেশনও তৈরি করেছেন তিনি। এ ছাড়া দেশে-বিদেশের জনপ্রিয় কিছু রেডিওর জন্য অ্যাপ তৈরি করেছেন। এর মধ্যে ‘লোকাল সিটি গাইড’ নামে একটি অ্যাপ্লিকেশন আছে, যা এক বছরে ডাউনলোড হয়েছে ১০ হাজার বারের বেশি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর তৈরি অ্যাপ্লিকেশন জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস ‘এনভেটোর কোডক্যানিওন’-এ ‘ফিচারড’ হয়। আগামীতে একটি দল গঠন করে আইওএস প্ল্যাটফর্ম ও গেইম ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পার্থের। ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি তিনি প্রযুক্তি নিয়ে দুটি বইও লিখেছেন, যা গত বছর ও এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
মাহমুদ হাসান সানি
মাহমুদ হাসান সানি ফ্রিল্যান্স সফটওয়্যার ডেভেলপার থেকে বর্তমানে উদ্যোক্তা। ১২ বছর আগে শুরু করেছিলেন শখের বশে। পরে এটাই হয়েছে তাঁর পেশা। এই ১২ বছরে প্রযুক্তির জগৎ পাল্টে গেছে অনেকাংশে। পাল্টে গেছে ডেভেলপমেন্টের চাহিদা। তিন বছর আগেও যখন ‘ডটনেট’ (.হবঃ)-এ কাজ করতেন, তখনই দেখলেন ধীরে ধীরে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে ডেস্কটপ সফটওয়্যারের চাহিদা ও প্রজেক্টের বাজেট কমে যাচ্ছে। বাড়ছে মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্টের চাহিদা। তাই নজর দিলেন সেদিকেই। অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘ওডেস্ক’ মাহমুদ হাসান সানির কাজের মান ও অভিজ্ঞতা দেখে তাঁকে ‘কান্ট্রি অ্যাম্বাসাডর’ হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওডেস্ক করপোরেশনের ‘কম্পিটিটর রিসার্চ’ করার অ্যাপটিও তাঁর বানানো। এখন মার্কেটপ্লেসে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বিজনেস অ্যাপ স্টেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সফলভাবেই চলছে এটি। তবে নিয়মিত অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট কর্মশালা, সেমিনারের মাধ্যমে দেশের মানুষকে এ পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ করাই তাঁর এখনকার প্রধান কাজ।
জাকির হোসাইন
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সদ্য স্নাতক জাকির হোসাইন। ওয়েব প্রোগ্রামার এবং মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন ওডেস্ক ও ইল্যান্সে। শুরুতে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাপ তৈরি করে দিতেন। অ্যাপ ডেভেলপ করে অ্যাপ স্টোরে আপলোড করলে আরো বেশি আয় হয়, তাই দেখে অ্যাপ ডেভেলপ করে নিজে গুগল প্লে স্টোরে আপলোড করা শুরু করলেন। সাড়া পেলেন ভালোই। তাঁর তৈরি বেশির ভাগ অ্যাপই দেশি ব্যবহারকারীদের জন্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ঢাকা বাস ম্যাপ’। এর মাধ্যমে ঢাকার মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে কোন বাস ব্যবহার করতে হবে, তা দেখে নিতে পারেন। ‘পিরিয়ডিক টেবিল’ নামে তাঁর আরেক অ্যাপের মাধ্যমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা পর্যায় সারণির বিভিন্ন মৌলের বিস্তারিত সহজেই জেনে নিতে পারবে। গাণিতিক সূত্রগুলো হাতের মুঠোয় আনতে তৈরি করেছেন ‘গাণিতিক সূত্রাবলি’ নামের অ্যাপ। এখন ডেভেলপ করছেন একটি গেইম। ঘুম থেকে উঠার আগেই আপনার প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করে এক মগ গরম কফি নিয়ে আপনার ঘুম ভাঙাবে এমন রোবট তৈরিতেও কাজ করছেন জাকির।
নূর ফারাজি
জীবনটা খুব সুখের ছিল না ফারাজির। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে একটি রেস্তোরাঁয় চাকরি নেন। ঝোঁক ছিল আঁকাঝোঁকার প্রতি। দেড় বছর পর একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ‘এরফান’-এ গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবে চাকরি পান। সেখানেই কাজ করতে গিয়ে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম মোবাইল অ্যাপ ও প্রোগ্রামিং সম্পর্কে জানতে পারেন। অ্যাপল, ব্ল্যাকবেরি, অ্যানড্রয়েড এবং ওয়েবের জন্য কাজ হতো তাঁর অফিসে। সেগুলোর গ্রাফিক্সের কাজ করতেন নূর ফারাজি, ১৫ হাজার টাকা করে পেতেন। এরপর ‘রাইজ আপ ল্যাব’ নামের আরেক প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পান। ভেবে দেখলেন, ডিজাইন থেকে ডেভেলপমেন্টে গেলে ভালো আয় করা যায়। যেহেতু কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন, তাই সে বিদ্যা আর সহকর্মীদের সহায়তায় ডেভেলপমেন্টের বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে থাকেন। শেখেন স্পেশাল ইফেক্ট ও থ্রিডি মডেলিং, গেইম সাউন্ড ও ভিডিও এডিটিং। এক সময় তৈরি করেন একটি গেইমের ট্রেইলারও। এরও দেড় বছর পর ‘গ্লুবার’ নামের একটি গেইম তৈরি করলেন, যেটি খুব জনপ্রিয়তা পায় এটি। পরে এক বন্ধুকে নিয়ে পুরোদমে গেইম ডেভেলপিং শুরু করলেন। বর্তমানে ওডেস্ক ও ইল্যান্সে ক্লায়েন্টের জন্য গেইম ডেভেলপিং করেন তাঁরা। গেইম স্টোরে তাঁদের ২০-টিরও বেশি ভালোমানের গেইম রয়েছে। এগুলো ডাউনলোডও হয় বেশ। সব মিলে সফল ডেভেলপারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন নূর ফারাজি।
নাকীবুল আরেফিন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ২০০৯ সালে স্নাতক শেষ করেন নাকীবুল আরেফিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে ‘কোডপিপল স্টুডিও’ নামের একটি স্টার্টআপ কম্পানিতে আইফোন ডেভেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে সফলতা আসায় পরে আইফোনের পাশাপাশি অ্যানড্রয়েড এবং উইন্ডোজ ফোনের অ্যাপসও ডেভেলপ করেন। এখানেও সফল হন। ২০১২ সালের শুরুর দিকে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্স অ্যাপস ডেভেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজের আইফোন ও ম্যাকবুক না থাকায় অ্যানড্রয়েড অ্যাপস ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর দেন। তবে এক ঘটনা পাল্টে দিল তাঁর কাজের পথ। যুক্তরাজ্যের একজন ক্লায়েন্টকে অ্যানড্রয়েড অ্যাপস বানিয়ে দেওয়ার পর সেই ক্লায়েন্ট তাঁকে একটি আইফোন এবং ম্যাকবুক কেনার জন্য ডলার পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ক্লায়েন্টের জন্য আইফোন অ্যাপস ডেভেলপ করে দেন তিনি। এরপর হেঁটেছেন আইওএসের পথে। দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর পাশাপাশি অ্যাপ স্টোর আইটিউনসের জন্য তৈরি করেছেন অনেক অ্যাপ। মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি বর্তমানে নিজের একটি নতুন উদ্যোগ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হিউমেক ল্যাপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেটাতে টেকনিক্যাল লিড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আব্বাস উদ্দীন
কক্সবাজারের ছেলে আব্বাস উদ্দিন ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ থেকে ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ক্যারিয়ার কিন্তু গড়েছেন অ্যাপ ডেভেলপমেন্টেই। ২০১০ সালে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করার পাশাপাশি নিজেই কিছু করবেন বলে চিন্তা করেন। মার্কেটপ্লেসে পার্টটাইম গেইম ডিজাইনের কাজ শুরু করেন। প্রথমে কয়েক মাস গেইম ডিজাইন করার পর শুরু করেন গেইম ডেভেলপমেন্ট। বিভিন্ন সমস্যার কারণে কাজ করার পরও সাফল্য পাচ্ছিলেন না। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও কাজ ডেলিভারি দিতে না পারা ছিল সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এখন আর এমনটা ঘটে না। একজন আত্মবিশ্বাসী ও সফল অ্যাপ ডেভেলপার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ডেভেলপ করেছেন ডজনখানেক গেইম। মার্কেটপ্লেসে এগুলো ভালো অবস্থানেই আছে। বর্তমানে একটি রেসিং গেইম তৈরি করছেন। নিজের গেইম ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট কম্পানি ‘পিক্সেল ১২ লিমিটেড’কে গেইমের জগতে একটি বড় নাম হিসেবে করাতে চান আব্বাস উদ্দিন।