Published On: Sun, Feb 2nd, 2014

উপজেলা নির্বাচন- কূটনীতিকদের দৃষ্টি জনমতের দিকে

Share This
Tags
imagesবিএনপিসহ প্রায় সব দলের অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে জনমত যাচাইয়ের বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। বিশেষ করে প্রধান দলগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ায় কার পক্ষে কতটা সমর্থন রয়েছে, তা যাচাইয়ের বড় মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে উপজেলা নির্বাচন। ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণসহ এ নির্বাচনের দিকে তারা বিশেষ দৃষ্টি রাখবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এশীয় কূটনীতিক গতকাল শনিবার বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে তাঁদের বলা হচ্ছে, একতরফা সংসদীয় নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ফলাফল অন্য রকম হতো বলে এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
ওই কূটনীতিক মনে করেন, বিএনপি যেহেতু আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাই সেখানে তাদের কতজন প্রার্থী নির্বাচিত হন, তা থেকেই জনসমর্থনের পাল্লাটা বোঝা যাবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, বাংলাদেশে উপজেলা নির্বাচন দলীয় না হলেও এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। সংবাদমাধ্যমের খবর এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কূটনীতিকরা যে তথ্য পাচ্ছেন তাতে তাঁদের ধারণা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। এ কারণে তারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরো জানায়, নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অনেকে বলেছেন, তাঁদের যে সত্যিই জনসমর্থন ছিল, তা উপজেলা নির্বাচনের ফল থেকে বোঝা যাবে। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়াতে চায় এ দলগুলো।
তথাকথিত স্বীকৃতির চ্যালেঞ্জ উতরেছে সরকার : একতরফা সংসদ নির্বাচন হলে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ আসবে- এমনটাই আশা করেছিল বর্জনকারী দলগুলো। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় ছিল বিভিন্ন মহল। তাদের ওই শঙ্কায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশ নিয়ে হতাশা আর পর্যবেক্ষণ না করার ঘোষণা। পশ্চিমা এক রাষ্ট্রদূত এমনও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নির্বাচন-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা করণীয় ঠিক করবেন। ভোটের পর প্রভাবশালী দেশগুলো আরেক দফা হতাশা প্রকাশ করলেও এক এক করে অভিনন্দনবার্তা আসতে শুরু করে বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে। পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগীদের অনেকে সরকারপ্রধানকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দনবার্তা না পাঠালেও নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকারকে সমর্থন দেওয়া না দেওয়ার মতো কোনো বিষয় এখানে নেই। কারণ সম্পর্ক হয় দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে। তাই সরকারের কারণে সেই সম্পর্কে ছেদ ঘটার ভাবনা অবান্তর। বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা আগের মতো যোগাযোগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়ায় তথাকথিত সমর্থন পাওয়া বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার যে চ্যালেঞ্জ ছিল, তাতে নতুন সরকার দৃশ্যত উতরে গেছে। তবে এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, বাংলাদেশ নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ কোনো আন্তর্জাতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ ইস্যু যেমন শান্তি-স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো বিষয়ে। এগুলোর সুস্পষ্ট অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের বলার সুযোগ থাকবে বলে জানান ওই কূটনৈতিক সূত্রগুলো।
নতুন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দায়িত্ব গ্রহণের দিনই সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের অভিনন্দন জানানো বা সমর্থন দেওয়া কূটনীতির ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তবে যারা অভিনন্দন জানিয়েছে, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি বলেন, ‘যারা অভিনন্দন জানায়নি তারা হয়তো আমাদের চাপে রাখার জন্য তা করেছে। তবে আমরা কোনো ধরনের চাপ অনুভব করছি না।’
বাংলাদেশে নতুন সরকারকে সমর্থন দেওয়াবিষয়ক প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র ম্যারি হার্ফ গত ১৪ জানুয়ারি বলেন, ‘সরকার হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়, আমরা নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে কাজ করি। তবে এ নির্বাচনে তাদের নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবেই আমাদের হতাশার কথা জানিয়েছি।’
ম্যারি হার্ফ বলেন, ‘(নতুন সরকারের সঙ্গে) অবশ্যই আমরা কাজ অব্যাহত রাখব। তবে একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথাও আমরা জানাতে থাকব।’
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের এশীয় অঞ্চলের পরিচালক রবার্ট হ্যাথাওয়ে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘অকার্যকর’ ভাবলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আপাতত ভাবছে না যুক্তরাষ্ট্র। বরং বাংলাদেশ ইস্যুতে নেওয়া হতে পারে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতি, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ পরিস্থিতির দিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখবে এবং এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি প্রত্যাশা করবে। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র চাপ দেওয়ার আগে বাংলাদেশের উচিত তার নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করা।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ‘স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচন না হওয়ার অভিযোগে ইইউ বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা বাতিল করতে পারে- বিভিন্ন মহলের এমন আশঙ্কা ও প্রচারণাকে নাকচ করেছেন ঢাকায় ইউরোপীয় ওই জোটের প্রতিনিধিদলের প্রধান উইলিয়াম হানা।
রাষ্ট্রদূত হানা বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে ইইউয়ের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথরিন অ্যাশটন যে দুটি বিবৃতি দিয়েছেন, সেগুলোর কোথাও বাণিজ্য বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে ইইউ বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধার কোনো পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করছে না। বাংলাদেশে ইইউয়ের উন্নয়ন সহযোগিতা আগের মতোই অব্যাহত থাকবে।
নতুন সরকার আসার পর বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সহযোগিতা কাটছাঁট হতে পারে- গণমাধ্যমে এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
সামনে আছে চ্যালেঞ্জ : কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে থাকে। গণতন্ত্র বা আইনের শাসন খাতে আগামী দিনগুলোতে সহযোগিতা কেমন পাওয়া যায় সেটিই দেখার বিষয়।
নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিমত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক সিনেট কমিটি, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্স। ইইউ পার্লামেন্ট বাংলাদেশ নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও তা বাংলাদেশের জন্য পরামর্শ বা তাগিদ। এটি পালনে বাংলাদেশের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আন্তর্জাতিক মহলে তা চাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংঘাত ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্যও নিন্দিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে কিছু দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নেতিবাচক প্রচারণাও আছে। নতুন সরকারকে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, সব শঙ্কা যে সরকার উতরে যেতে পেরেছে, তা এখনই বলা কঠিন। নতুন সরকার সবেমাত্র কাজ শুরু করল। তবে বাংলাদেশে মানবাধিকারবিষয়ক উদ্বেগগুলো সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের মাধ্যমে এসেছে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ সুশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এসব বিষয়ে যত বেশি গঠনমূলক কাজ হবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির। এগুলো হলো- ১. দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি দ্রুত ফিরিয়ে আনা, ২. ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, ৩. বিদেশে অধিক হারে জনশক্তি প্রেরণ ও রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করা এবং ৪. দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন  বলেন, নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া না দেওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই। এ ধরনের ধারণা গণমাধ্যম ও বিরোধীরাই সৃষ্টি করেছে। বিদেশিরা অন্য দেশে গিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ওই দেশের জনগণই তা করতে পারে। তিনি বলেন, বিদেশিরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সরকারের কাছ থেকে যতটা বেশি সম্ভব সুবিধা নেওয়া। কোনো দেশে অনির্বাচিত বা সামরিক সরকার এলেও তার সঙ্গে বিদেশিরা কাজ করে।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, নতুন সরকারের উচিত অর্থনৈতিক ও পূর্বমুখী কূটনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া। ভারতকে বিগত আমলে অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এবার ভারতের কাছ থেকে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পুনঃসম্পৃক্ত করার বিষয়েও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
অপপ্রচার মোকাবিলায় উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার : বিদেশে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশে নানা মহলের অপপ্রচার মোকাবিলায় সঠিক তথ্য তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজে আরো সমন্বয় সাধন এবং বাংলাদেশ মিশনগুলোর প্রেস উইংকে আরো শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানা ইস্যুতে বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। গত সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এ নেতিবাচক প্রচারণা আরো জোরদার হয়। এ ধরনের প্রচারণা দেশের ভাবমূর্তির জন্য বড় হুমকি। এটি মোকাবিলা করাকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার মনে করে, সঠিক তথ্য তুলে ধরার মাধ্যমেই এটি মোকাবিলা সম্ভব।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.