অবৈধ কাজের বৈধ স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান!
রিজওয়ান করিম : শহরের মানুষের কর্মময় ব্যস্ত জীবনে একটু সবুজ-সতেজ বাতাস যোগান দেয় পার্ক বা উদ্যান। অবসরে চোখ আর মনের খোরাক জোগাতেই পার্কের দ্বারস্থ হয় মানুষ।
ঢাকা শহরে যে কয়টি উদ্যান আছে তার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের রাজাকারদের বিরুদ্ধে ফাঁসির গণরায়, বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কারণে এই স্থানটি ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিকভাবে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি সংরক্ষিত উন্নত শৈলীর স্থাপনার দাবি রাখে। কিন্তু এ উদ্যানের বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে কোন অবৈধ কাজটি হয় না?
মাদক সেবন, দেহ ব্যবসা, জুয়া খেলা, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তি, প্রেমিক-প্রেমিকাকে অবৈধ কাজে সাহায্য করা ইত্যাদি। এসব কাজ যেন এখানে বৈধ। এ উদ্যানে এসব করা হয় প্রকাশ্যে। দেখার কেউই নেই।
মানুষ এখানে আসে ব্যায়াম করতে আর পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু নির্জন-নিবৃত্তে সময় কাটাতে। সজীব বাতাসের জন্য এসে তারা পায় গাঁজা আর হেরোইনের গন্ধ।
উদ্যানের ভেতরে এবং আশে-পাশে গড়ে উঠেছে কয়েকশ অবৈধ দোকান। মানুষ যে একটু ভেতরে গিয়ে হাঁটবে তার সুযোগও নেই। দোকানগুলোর নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্সও।
দোকানদারদের দাবি, এখানে ব্যবসা করতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা এবং প্রভাবশালী মহলকে দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার ঢাকাবিডি টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েক মাস আগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন নেতাদেকে ম্যানেজ করে দোকান দেই। কাজেই তাদের ভাগ দিতে হয়।’
দেখা যায়, রাজুভাস্কর্যের পাশে অবস্থিত উদ্যানের ফটকের পাশেসহ ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় চা, সিগারেট, ডাব, নাস্তা এবং ফুচকার অসংখ্য দোকান গড়ে উঠেছে।
ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার রাস্তায় এসে পড়েছে দোকানের ক্রেতাদের বসার জন্য রাখা বেঞ্চ এবং চেয়ারগুলো। তাছাড়া রাস্তার পাশে দোকানগুলো থাকায় দোকানের ক্রেতাদের দাঁড়াতে হয় রাস্তার উপর।
ব্যায়াম করার উদ্দেশ্যে যারা এখানে আসেন তারা প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কথা হলো ওমর ফারুক নামের একজন চাকরিজীবীর সাথে। তিনি বলেন, ‘বিশ বছর আগে থেকে এখানে নিয়মিত আসি। বর্তমানের মতো খারাপ অবস্থা আগে দেখেনি। যেখানে-সেখানে দোকান হওয়ায় একটু যে বাধা-বিঘ্ন ছাড়া দৌড়াবো তারও সুযোগ নেই। আর মটরসাইকেলের চালকরা তো লাগামহীন। পারলে গায়ের উপর দিয়ে উঠিয়ে দেয়।’
এখানে বেড়াতে আসলে মনে হবে সত্যিকার অর্থেই এই উদ্যানের এখন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। অথচ পাশেই রয়েছে শাহবাগ থানা।
উদ্যানের যত্রতত্র নেশাখোরদের আড্ডা, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়, দোকানপাট, ভবঘুরেদের অস্থায়ী আস্তানা, ভুয়া লালন চর্চা কেন্দ্র, ছিনতাইকারী ও বখাটেদের আনাগোনা আর গোপন লেনদেনের ঝুপড়ি ঘর এই উদ্যানের নিয়তি যেন অনেকটাই নির্ধারণ করে দিয়েছে। উদ্যানের ভেতর অবৈধ পার্কিং, অস্থায়ী ঘর ও দোকানপাটে ভরে গেছে। মাঝখানের ফাঁকা স্থানে ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। ঝুপড়ি ঘরের লোকজন রীতিমতো বসতি গড়ে তুলেছে এখানে। গাছতলায় চুলা জ্বালিয়ে রান্না করে, গাছের ডালে দড়ি টানিয়ে শুকোতে দিয়েছে জামা-কাপড়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তির আন্দোলন সম্পর্কিত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর সাথে উদ্যানের বর্তমান এই অবস্থা সচেতন তরুণ সমাজ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। এজন্য তারা প্রশাসনের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতাকে দায়ী করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ ফরহাদ উদ্দীন বলেন, ‘এই উদ্যানে গেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে জাতির পিতার আহ্বানে কীভাবে সেদিন লাখ জনতা শপথ নিয়েছিল। আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে এভাবেই দেখি। কিন্তু পার্কের এই অবস্থা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম পার্কে আসবে না। ঐতিহাসিক স্থান থেকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ তারা হারাবে।’
এই পার্কের নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলী ঢাকাবিডি টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, ‘পার্কটি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বের মধ্যে না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত হওয়ার জন্য এ দায় আমদের উপরও বর্তায়। আমরা পুলিশ প্রশাসনের সাথে বিষয়টি নিয়ে অসংখ্যবার বসেছি। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের তাগাদা দিয়েছি যেন পার্কে ভেতরে এই ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে। বিশেষ করে নতুন কিছু মাজার গড়ে উঠতে শুরু করেছে যা নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। এই সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই হুমকির মুখে পড়বে।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ সমস্যাগুলোর সমাধানের কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আরো কিছু ক্ষতিকর প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।’
এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম ঢাকাবিডি টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে এই উদ্যানকে আমারা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দায়িত্বপালন করে থাকি। চার পাশের দেয়াল প্রাচীরের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলেই এই ধরনের ঘটনা কমে যাবে।’