র্যাব ভ্যাট আদায়ে যুক্ত হবে

মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষে অভিযান চালাতে চায় র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ জন্য প্রচলিত ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
বর্তমান আইনে এনবিআর ভ্যাট আদায় ও ভ্যাট ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ভ্যাট ফাঁকি রোধে ভ্যাট গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করে। আর ভ্যাট আইনের ২৪ ধারায় বলা রয়েছে, চাইলে এনবিআর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে পারবে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংশোধন করে র্যাবকে ভ্যাট আদায়ে যুক্ত করার জন্য এনবিআরের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে র্যাব। এনবিআর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা এমন উদ্যোগ অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, এটা একটা বিশেষায়িত কাজ। কেবল এনবিআরের সেই অভিজ্ঞতা আছে।
জানতে চাইলে এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান র্যাবের প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বিদ্যমান আইনানুযায়ী আমরাই ভ্যাট আদায় করব। প্রয়োজন হলে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেব।’
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের স্বাক্ষরে পাঠানো প্রস্তাবে র্যাবের বিভিন্ন অভিযান দেশের সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, খাদ্যদ্রব্য ভেজাল, ভেজাল ওষুধ ও কসমেটিকস, ভুয়া ডাক্তার, লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অবৈধ ব্লাড ব্যাংক, অবৈধভাবে বন্য প্রাণী ক্রয়বিক্রয়-সংক্রান্ত অপরাধসহ মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর তফসিলভুক্ত অন্যান্য আইনে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছেন।
কিন্তু মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় ওই আইনে হওয়া অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একদিকে যেমন ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা বাড়ছে, অন্যদিকে সরকার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে মূল্য সংযোজন কর আইনকে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর তফসিলভুক্ত করা হলে কাস্টমস ও ভ্যাট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্যাট ফাঁকির বিরুদ্ধে আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এতে ব্যবসায়ী সমাজ সরকারের রাজস্ব আদায়ে তাদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাশাপাশি ক্রেতার অধিকারও সুরক্ষিত হবে। সামগ্রিকভাবে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা কমবে এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। এই প্রস্তাবের একটি অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও দিয়েছে র্যাব।
এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কী—জানতে চাইলে র্যাবের বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সহযোগিতা করতেই এ প্রস্তাব দিয়েছি। বর্তমানে আমরা স্বাস্থ্য, বিএসটিআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছি। আমাদের বেশির ভাগ অভিযানই সফল ও প্রশংসিত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, দোকানগুলো থেকে ঠিকমতো ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। সারা বিশ্বেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জরিমানা করা হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব দিলে আমরা সেটাই করব।’
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল শনিবার বলেন, ‘এ প্রস্তাবের বিষয়ে আমি কিছু শুনিনি, জানিও না।’ তিনি বলেন, যার যার কাজ তারই করা উচিত।
র্যাবের এ প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই অভিযান পরিচালনা কেন করবে, তা ঠিক বোধগম্য নয়। এ জন্য এনবিআরের নির্দিষ্ট লোক আছে, যারা এই কাজে অভিজ্ঞ। যার কাজ তাকে দিয়ে করাতে হবে।
এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা এমনিতেই ভ্যাট কর্মকর্তাদের দোষারোপ করে থাকেন, হয়রানির অভিযোগ করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর অনুমোদন দিলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। সবকিছু পর্যালোচনা করেই র্যাবের প্রস্তাবের জবাব দিতে হবে।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ বলেন, ভ্যাট ফাঁকি রোধে র্যাব মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ফেডারেশন অব চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়, হয়রানি চায় না। যারা কর দিতে চায় না, তাদের জন্য এ উদ্যোগ হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু ভালো ব্যবসায়ী যারা কর ফাঁকি দেয় না, কখনো তাদের চুল পরিমাণ হয়রানি করলেও আমরা মানব না।’
র্যাব মূলত সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই র্যাব গোয়েন্দা ও আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে।
র্যাবের ভ্যাট আদায়ের অভিযান পরিচালনার প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাজ তাদেরই করতে দিতে হবে। এটা রযাল বের কাজের মধ্যে পড়ে না। এ প্রস্তাব মেনে নিলে ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিচার হতে পারে।
এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন পাস হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে বলে বাজেট বক্তব্যেই ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মাঝপথে এ ধরনের উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভ্যাট নিয়ে যেকোনো দেশের আইনি পরিবর্তনের তথ্য সরাসরি পান উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে তাঁর জানা নেই।
সুত্র – প্রথম আলো