Published On: Sat, Jun 22nd, 2013

বাঙালির বিপ্লব‏

Share This
Tags

revwallpaper  রিজওয়ান করিম –  বাঙালী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে আসছে। দেখে আসছে তো আসছেই, স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। কবে থেকে দেখছে? কে জানে! বাঙালী বিপ্লবী, বিদ্রোহী। সে অত্যাচারিত হতে হতে ঘুরে দাড়াতে জানে। তা তিতুমীর-শরিয়তুল্লাহ দের ইসলামী বিপ্লব হোক, ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ হোক, কিংবা হোক ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ (যাকে মহামতি কার্ল মার্ক্স এদেশের মানুষের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন) । সবখানেই বাঙালী দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে নিজের ব্যাকুলতা বুঝিয়েছে। এই মুক্তি কি শুধু একটুকরো ভূখন্ডের মুক্তি? মনে হয়না। এই মুক্তির আকুতিকে সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে, সমস্ত ব্যারিকেড ভেঙে বাঁচার মত বাঁচার আকুতি বলাই যায়।
১৯১৭ সালের অক্টোবর। হ্যা, ঐতিহাসিক অক্টোবর বিপ্লব। সোভিয়েত ইউনিয়নের গঠন, এবং তা বাঙালীর চেতনায় আবার আঘাত হানলো। এসে গেলো সমাজ প্রগতি, মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদের বহুল চর্চা। বাঙালী যেন পেয়ে গেলো তার বিপ্লবের পথ, বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই ধরে নিলেন, এভাবেই হবে! অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেকেই সোভিয়েতের হাওয়া গা পেতে নিলেন না, কিন্তু যারা নিলেন, তাদের সংখ্যাই বা কম কি? সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে তারা ধরে নিলো পথের দিশা হিসেবে, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে বিপ্লবের শেষ কথা। তার আগে, ১৯০৮ সালে কিংবদন্তীতুল্য হয়েছেন আরেক বাঙালী, ক্ষুদিরাম বসু। ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনেও বাঙালীরা ভূমিকা রাখলো। সাম্যবাদে দীক্ষিত হয়ে লড়লেন মাস্টারদা, তিনি আর তার দল বাংলার আরেক কিংবদন্তী হয়েই রইলো। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ-মুক্তি এলো, মুসলিমরা অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের
আশায় চিল্লাফাল্লা করে পাকিস্তান আলাদা করলেন, কিন্তু বিপ্লব কি সফল হল? বাঙালী কি বন্ধনমুক্ত হল? এই প্রশ্ন এখন করা অবান্তর। সেদিন বাঙালীর মুক্তি লাভের আকুতি ফলাফল লাভ করেনি, বিপ্লবও সফল হয়নি।
তারপর? বাঙালী হাঁসফাঁস করতে করতে ঘুরে দাঁড়ালো, ‘৫২, ‘৫৪ ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০, ‘৭১- একেকটি মহাকাব্যের নাম। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ভূখন্ডের আশা তো পূর্ণ হল, বাঙালী ভাবল মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার। তার আগেই দেশে দাঁড়িয়ে গেছে আরেক দল, যারা মুক্তির আরেক রাস্তা বাতলাচ্ছেন। এদের রাস্তাও সাম্যবাদ, গলিঘুপচি হয়ে রাস্তায় ওঠার পদ্ধতি আলাদা। ১৯৪৯ এর চীনা বিপ্লব। ষাটের দশকেই এদেশের জানালা দিয়ে ঢুকল মাওবাদ, যা গ্রহণ করল হাজার হাজার তরুণ। তাদের কাছে সোভিয়েত না, চীনই বিপ্লবের আইকন, চোখ বুজে বেছে নিল সশস্ত্র বিপ্লব। একজন চারু মজুমদার বা একজন সিরাজ সিকদার হয়ে উঠলেন বিপ্লবের বাঁশিওয়ালা, ক্রেজ! কিন্তু বিপ্লব কি হল? কেন হল না? সেকথা পরে আলোচনা করা যাবে। হল না, এইটাই বড় কথা!
তো যা বলছিলাম। বাঙালী ভূখন্ড পেল, ভাবল এবার প্রকৃত মুক্তির দিন অত্যাসন্ন। আমরা স্বাবলম্বী হব, বিদেশের ক্রীড়নক হয়ে থাকব না, অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। কিন্তু কিচ্ছু ঘটল না। না পারলো মাওবাদীরা, না পারলো লেনিনবাদীরা। পারলো না আওয়ামী পন্থীরাও। আওয়ামী লীগ নামের দলটির দেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরাট অবদান, তারাও পারলো না মুক্তির প্রকৃত স্বাদ এনে দিতে। চড়াই উতরাই আরো বাকী। সামরিক শাসন এলো, সেখান থেকে বাঙালী আবার গর্জে উঠে গণতন্ত্রও ফিরিয়ে আনল। কিন্তু মুক্তি? আর বিপ্লব? সেইটা অধরাই রইলো!
এর মাঝেই সোভিয়েতের পতন। সোভিয়েতের পতন এক ধারার বিপ্লবীদের জোরেসোরে ধাক্কা দিলো, তাদের অনেকেই বিপ্লবের মোহ ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। বাকীরা? হাস্যকরভাবে পতন হয়ে যাওয়া ‘সোভিয়েতের বিপ্লব নিয়ে বসে রইলেন!(লেনিনবাদ অবশ্যই অনুসরনীয়। স্তালিন একে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারার যুগের মার্ক্সবাদ বলেছেন, একেবারে ভুল বলেননি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট একটু আলাদা বলেই আমার ধারণা) । শতবর্ষ
আগের তত্ত্বে বিপ্লব ঘটানোর মন্ত্র জপতে লাগলেন! বিংশ শতাব্দী আর একবিংশ শতাব্দী এক না, সোভিয়েত আর বাংলাদেশও এক না! অথচ সোভিয়েতকেই শেষ কথা হিসেবে ধরলেন তারা!
আর থাকলো মাওবাদী। তারাও বিপ্লব ঘটাতে পারলেন না। মাওকে অন্ধের মত এদেশে ফলাতে গিয়ে ক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। একটা সময় সাধারণ মানুষ তাদের জনবিচ্ছিন্ন ডাকাত বলেই চিহ্নিত করলো। শহুরে শিক্ষিত সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে গেলো। তারাও পারলো না, বিপ্লব করতে।
এদেশে আবার বাসা বাধল ইসলামী বিপ্লবের প্রয়াস। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত হয়ে ইসলামী শরীয়াহ কায়েমের স্বপ্ন, যা অনেকের কাছে স্বর্গের মত। তারাও বিপ্লবের স্বপ্নই দেখেছে, দেশের বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্নই দেখেছে, হতে পারে তারা ভ্রান্তির জগতে। তাদের বিপ্লবও হল না (যুক্তিসঙ্গতভাবেই হওয়া সম্ভবও না) ।
তো দেশে এখন কয়েক ধারার বিপ্লবী। মাওবাদী, ইসলামবাদী, সোভিয়েতবাদী, কিংবা নব্য তরুণ সম্প্রদায়, যারা চে গুয়েভারাকে বিপ্লবের শেষ কথা বলে মানে। ইসলামী বিপ্লবকে একেবারে বাতিল করাই যায় হয়ত, কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাংলা কখনোই রাশিয়া নয়, চীন নয়, নয় কিউবা। এসব জায়গার বিপ্লব পুরোপুরি সফল কি অসফল সে কথায় আসছি না। কথা হল, বাঙালী বিপ্লব করতে এতোদিনে পারেনি, এখনও যে পারবে না তা নয়। তাহলে?

বাঙালীর বিপ্লব হতে হবে বাঙালীর মত, যাতে সেই বিপ্লব প্রকৃত মুক্তির পথ হিসেবে দেখা দেয়। চীন, কিউবা বা রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব কিংবা মুক্তি লাভের বিপ্লব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে, জানার আছে, নেওয়ারও আছে। কিন্তু হুবহু অনুসরণ করার? কিচ্ছু নেই বলেই আমার ধারণা! বাঙালীর বিপ্লব বাঙালীকেই করতে হবে, এবং বাঙালীর উপায়েই! যে বিপ্লব হবে পরিকল্পিত, এবং বাঙালী জানবে বিপ্লবের পর কি করবে সে! তাহলেই মুক্তি সম্ভব! যে মুক্তির আশায় বারবার মাথা তুলতে চেয়েছে বাঙালী!

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.