Published On: Thu, Jul 24th, 2014

আগামী দিনের শিক্ষা : ই-লার্নিং

Share This
Tags

eবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। উধাও হয়ে যাচ্ছে চার দেয়ালে বন্দী শিক্ষাব্যবস্থাও। এখন শিক্ষা মানেই বৈশ্বিক ভাবনা, বৈশ্বিক যোগাযোগ। মাত্র দুই দশক আগে যা ছিল দূরের, এখন তা হাতের মুঠোয়। শিক্ষায় আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার এত বিস্তৃত ব্যবহার হচ্ছে এবং সেটাও আবার এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে তার নিত্যবিকাশের খবর রাখাও দুঃসাধ্য।
প্রাচীনকালে শিক্ষা বন্দী ছিল হয় রাজপ্রাসাদে, নয় গুরুগৃহে। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকারই ছিল না। ইসলাম প্রথম মানুষের জন্মনির্বিশেষে সবার শিক্ষায় সমানাধিকারের স্বীকৃতি দেয়। ইসলামে প্রত্যেক নরনারীর জন্য বিদ্যার্জন ফরজ করা হয় এবং এক ঘণ্টার জ্ঞানচর্চাকে হাজার রজনীর এবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হয়। তার হাজার বছর পর ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা অর্জনের অধিকারের স্বীকৃতি মেলে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষালাভকে কেবল অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, প্রত্যেক নাগরিককে বিদ্যার্জনের সব সুযোগ অবারিত করে সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে এবং প্রত্যেক সোভিয়েত নাগরিককে বিদ্যার্জনে বাধ্য করে। শিক্ষার যাবতীয় ব্যয় ও কর্তব্যাদি রাষ্ট্র বহন ও পালন করে। ফলে মানবসভ্যতা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শিক্ষাও অন্যান্য শিল্পপণ্যের মতোই একটি লাভজনক পণ্য। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এই বাণিজ্যিক পণ্যের উৎপাদক এবং বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো তার অসহায় ভোক্তা। এই ব্যবস্থায় দরিদ্র দেশগুলো তাদের যাবতীয় সামর্থ্য উজাড় করে যাদের বিশেষজ্ঞ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে, পশ্চিমের ধনী দেশগুলো তাদের বেশি বেতনে কিনে নিয়ে যায়। এই মেধা পাচারের ফলে গরিব দেশে থেকে যায় নিম্নজ্ঞান ও নিম্নদক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী, যারা জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনে সামান্যই অবদান রাখতে পারে।
তাহলে কি সামর্থ্যহীন মানুষ বা দেশের জনগণের জন্য শিক্ষার প্রবেশদ্বার চিরকালই রুদ্ধ থাকবে? মানবদরদি শিক্ষাবিদেরা এ সমস্যার একটি সমাধান খুঁজছিলেন। রেডিও আবিষ্কারের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ১৯৬০–এর দশকে এ প্রশ্নের জবাব খঁুজে পান তঁারা। রেডিওকে শিক্ষাদানের কাজে ব্যবহার শুরু করেন, যাতে বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ানোর সৌভাগ্যবঞ্চিত মানুষ ঘরে বসে শিক্ষা লাভ করতে পারে।
মুক্তশিক্ষার এই ব্যবস্থা সারা দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে৷ কিন্তু এই ব্যবস্থায় একটি সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছিল না। সেটা হলো, ঠিক যখন রেডিওতে শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, কোনো কারণে কেউ যদি তা তখন শুনতে না পারে কিংবা একবার শুনে মনে রাখতে না পারলে আরেকবার শোনার ব্যবস্থা কী হবে? অনুষ্ঠানটি বারবার প্রচার করে তারও সমাধান হলো বটে, কিন্তু যখন খুশি তখন শোনার সুযোগ তাতে হচ্ছিল না।
বিজ্ঞানের আরেকটি নতুন আবিষ্কার টেপ রেকর্ডার মুক্ত বা দূর শিক্ষণকে অনেক সহজ করে দেয়। আমাদের দেশে গত শতকের শেষ পর্যন্ত এই প্রযুক্তিই ছিল ভরসা। এরপর তার সঙ্গে যুক্ত হলো ভিডিও। এখন শুধু শোনা নয়, শিক্ষককে দেখা বা শিক্ষকের পক্ষে কোনো কিছু করে দেখানো সহজ হয়ে যায়।
কম্পিউটার সহজলভ্য হলে এবং ব্যবহার কৌশল আরও সহজ হয়ে গেলে কম্পিউটার প্রযুক্তি দূরশিক্ষণের খোলনলচে বদলে দেয়। প্রথমে ফ্লপি ডিস্ক, অতি অল্প দিনের মধ্যেই কম্প্যাক্ট ডিস্ক, অডিও এবং অচিরেই ভিডিও ডিস্ক শিক্ষা ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আরও সহজ করে তোলে। এই প্রযুক্তি চালু হতে না–হতেই এক বিপ্লব ঘটে যায় যখন আবিষ্কৃত হয় ইন্টারনেট যোগাযোগব্যবস্থা। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পরপরই বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের প্রায় সব কর্মকাণ্ডে ঘটে যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির দাবি যত প্রবল হয়, ততই দ্রুত চালু হয়ে যায় ই-গভর্ন্যান্স, ই-ব্যাংকিং, ই-লার্নিং ইত্যাদি। এক কথায়, জীবনের পরতে পরতে এখন ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার। ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, পামটপের কাল কবে বাসি হয়ে গেল, তা বুঝতে না–ুঝতেই এসে গেল মোবাইল ফোনভিত্তিক নিত্যনতুন অ্যাপ্লিকেশন বা সংক্ষেপে অ্যাপস। মোবাইল অ্যাপসের কল্যাণে দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়।
ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক লার্নিং বা সংক্ষেপে ই-লার্নিং। রেডিও থেকে মোবাইল অ্যাপস পর্যন্ত যেসব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করা হলো, তা সবই ই-লার্নিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এই শিক্ষা ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তিনির্ভর, যে প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। ই-লার্নিং বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। এই প্রযুক্তি শিক্ষকের ভিডিও ক্লিপ, ডিজিটাল কনটেন্ট ইচ্ছেমতো বারবার দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি, স্কাইপ, ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তির আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষেÿ শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে দূরে রেখেও মুখোমুখি বসাতে পেরেছে। যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি। তরুণ প্রজন্মের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় এই দুটি যোগাযোগমাধ্যম এখন শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। অতিসম্প্রতি যুক্ত হয়েছে স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপস।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অন্তত এক দশক শিক্ষােক্ষত্রে মোবাইল অ্যাপস একচ্ছত্র আধিপত্য করবে। তবে প্রযুক্তির অতি দ্রুত পরিবর্তনের এই যুগে অচিরেই হয়তো নতুন কোনো প্রযুক্তি মোবাইল অ্যাপস প্রযুক্তিকেও পেছনে ফেলে দেবে। এভাবে ই-লার্নিং শিক্ষার এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এই ব্যবস্থা মানুষের শ্রম যেমন লাঘব করেছে, তেমনি বহুগুণে সাশ্রয় ঘটিয়েছে সময় ও অর্থের। আমাদের দেশেও ই-লার্নিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ই-লার্নিং এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী রূপান্তর ঘটাতে পারে।

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.