মেয়াদ শেষের আগেই নির্বাচন হওয়ায় দায়িত্ব পাচ্ছেন না ৪ মেয়র
আইনি জটিলতার কারণে আগামী অক্টোবরের আগে দায়িত্ব নিতে পারছেন না চার সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা। ওই চার সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় এই আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনাকে আইনের ‘মারাত্মক ত্রুটি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। আমলাদের তৈরি করা আইন সংসদে উপস্থাপনের পর তা ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তাদের অভিমত। এদিকে আগের মেয়ররা পদত্যাগ করে নির্বাচন করলেও কাউন্সিলররা স্বপদে বহাল রয়েছেন। মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলররা মেয়রবিহীন অবস্থায়ই দায়িত্ব পালন করবেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, আইনের এই জটিলতার কারণে আগামী দুই মাসের মধ্যে নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বিজয়ী ঘোষণার গেজেটও প্রকাশ করতে পারছে না তারা। কারণ গেজেট প্রকাশের এক মাসের মধ্যে শপথ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে গেজেট প্রকাশ করলে এক মাসের মধ্যে শপথ নিতে হবে নবনির্বাচিতদের। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সেটা কোনভাবেই সম্ভব হবে না।
জানা গেছে, মেয়াদ শেষের প্রায় চার মাস (মে) আগেই রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট- এই চার সিটির মেয়ররা পদত্যাগ করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যদিও তারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ৬ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘করপোরেশনের মেয়াদ উহা গঠিত হইবার পর উহার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হইবার তারিখ হইতে পাঁচ বত্সর হইবে’। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর ভিন্ন ভিন্ন তারিখে চার সিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে আইনে একদিকে করপোরেশনের মেয়াদ পাঁচ বছর বেঁধে দেয়া হয়েছে, আবার মেয়াদ শেষের আগের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশনাও রয়েছে। সে অনুযায়ী এ বছরের ৭ অক্টোবরের মধ্যে বরিশাল, ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজশাহী ও সিলেট এবং ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির কারণে নির্বাচন কমিশন নির্দেশনা অনুযায়ী মেয়াদ শেষের প্রায় পাঁচ মাস আগেই (এপ্রিল) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।
অর্থাত্ এসব সিটি করপোরেশনের কোন কোনটির মেয়াদ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে। তার মানে মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চার সিটির নবনির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলররা আইনের (২) উপ-ধারা (১) এর দফা (খ) অনুযায়ী দায়িত্ব নিতে পারবেন না। এছাড়া আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘মেয়র এবং কাউন্সিলর হিসাবে নির্বাচিত সকল ব্যক্তির নাম নির্বাচনের পর, নির্বাচন কমিশন যথাশীঘ্র সম্ভব সরকারি গেজেটে প্রকাশ করিবে’। কিন্তু ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ গেজেট প্রকাশের এই নির্দেশনা সৃষ্ট আইনি জটিলতার কারণে পালন করতে পারছে না কমিশন। সবকিছু চূড়ান্তের পরেও ফলাফল বিবরণী নিয়ে আরো দুই মাস বসে থাকতে হবে তাদের । কেননা আইনের ৭ ধারার উপ-ধারা ২-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘গেজেট প্রকাশের এক মাসের মধ্যে নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরকে শপথ গ্রহণ করতে হবে। যদি এই সময়ের মধ্যে তারা শপথ না পড়েন তাহলে তাদের পদ শূন্য ঘোষিত হবে।’
প্রসঙ্গত, শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। অক্টোবরের আগে শপথ নিলে একই সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থাকবেন দুই দল। একদল নবনির্বাচিত, আরেক দল বিদায়ী। অন্যদিকে একই করপোরেশনে একজন থাকবেন নবনির্বাচিত মেয়র ও অন্যজন প্যানেল মেয়র। অর্থাত্ পুরাতনদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নবনির্বাচিতদের শপথও করাতে পারবে না সরকার।
বিষয়টিকে আইনের ‘মারাত্মক ত্রুটি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, আমলাতন্ত্রের কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সাধারণত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে মেয়াদ শেষের পরবর্তী ৯০ বা ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু নতুন করে মেয়াদ শেষের আগের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে । আসলে এর মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট আইনের মাধ্যমে কর্তন করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা দেখছি সরকারি কর্মকর্তারা এসব প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে নানা জটিলতা তৈরি করে। যদিও সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ জুন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেয়র পদে রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় মনিরুজ্জামান মনি, বরিশালে আহসান হাবিব কামাল ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী জয়লাভ করেন। এরা প্রত্যেকেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন।