Published On: Sat, Apr 18th, 2015

বাংলাদেশ এর কাছে পাকিস্থানের পরাজয়

Share This
Tags

Bangladeshi-captain-Mushfiqur-Rahim-R-congratulates-teammate-Nazmul-Hossain-

সবার সঙ্গেই পারে বাংলাদেশ। পারে না কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে। যেন এভারেস্ট-কেটু-কাঞ্চনজঙ্ঘা পাড়ি দেওয়া অভিযাত্রী অন্নপূর্ণায় উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে প্রতিবার। এ এক অদ্ভুত রহস্য! আশ্চর্য ধাঁধা!

এই ধাঁধার উত্তর ১৬ বছর ধরে খুঁজে ফিরছিল বাংলাদেশ। পৌনে তিন শ ওয়ানডের রহস্যজটে আটকা ছিল তা। কখনো আইজাজ চিমার মতো অখ্যাত কেউ হয়ে যান লাল-সবুজের স্বপ্ন হন্তারক। আবার কখনো শহীদ আফ্রিদির মতো বিখ্যাত কারো ব্যাটিং তাণ্ডবে বেজে ওঠে হৃদয়ভাঙার তানপুরা। আর সেটিও একবার-দুবার তো নয়! বারবার।

কাল অবশেষে শেষ হয় সেই গ্রহণকাল। বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়ি দেয় বিষণ্ন আঁধারের বিপন্ন বিস্ময়কাল। আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে বেজে ওঠে জয়ঢাক। ফ্লাডলাইটের আলোকবন্যার ওপরের উপুড় আকাশে যে অন্ধকার, সেখানে অদৃশ্যে ওড়ে কতশত জয়নিশান! ৭৯ রানের এই জয়টি যে বাংলাদেশের জন্য সিরিজে এগিয়ে যাওয়া শুধুই আরেকটি জয় নয়! এর চেয়ে ঢের বেশি কিছু। ১৬ বছরের অপ্রাপ্তি ঘোচানোর উল্লাস। পৌনে তিন শ ওয়ানডের হাহাকার মোছানোর উৎসব। ৩১ মে ১৯৯৯ থেকে ১৭ এপ্রিল ২০১৫। মহাকালের পঞ্জিকার পাড়ি দেওয়া ১৫ বছর সাড়ে ১০ মাস সময়। সেদিনের নর্দাম্পটনের পর কালকের মিরপুর। বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট খেরোখাতায় আঁচড় কেটে যাওয়া ২৭৩ ম্যাচ। এই প্রায় ১৬ বছরে প্রায় পৌনে তিন শ ম্যাচে কোনো দলই অজেয় থাকেনি বাংলাদেশের সামনে। না অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা-ভারতের মতো পরাক্রমশালী; না নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তি; না জিম্বাবুয়ে-আয়ারল্যান্ড-কেনিয়ার মতো ক্রিকেটের পেছনের সারির ছাত্ররা। এ সময়ে শুধু ৮৫টি ওয়ানডে জেতেনি বাংলাদেশ। বরং বলা ভালো, হেন দল নেই জেতেনি যার বিপক্ষে। ব্যতিক্রম কেবল পাকিস্তান। কেবলই পাকিস্তান।

মাঝের এই দেড় দশকে বাংলাদেশ এক ম্যাচও জিততে পারেনি তাদের বিপক্ষে। ২৫ দ্বৈরথের প্রতিটিতে পুড়তে হয় পরাজয়ের আগুনে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটন-মহাকাব্যের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা মানেই তাই বাংলাদেশের জন্য বেদনার অনুকাব্য। বছরের পর বছর ম্যাচের পর ম্যাচে জমা সেই ‘বিন্দু বিন্দু জল’ মিলে ‘মহাসাগর অতল’ হওয়ার দশা।

কাল সেই বেদনার মহাসাগরে আবার শোনা যায় আনন্দ-কল্লোল। ওঠে উল্লাসের ঊর্মিমালা। ১৬ বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের একতারার টুংটাং সুরে নাচে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণ। খেরোখাতার জয়খরা কাটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথমার্ধে ঠিক তাই তাই করেছে বাংলাদেশ। নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের চূড়ায় চড়ে, ৩০৯তম ম্যাচে প্রথমবারের মতো এক ইনিংসে দুই সেঞ্চুরিয়ানের দেখা পেয়ে। যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি গড়ে। এই রেকর্ড ত্রয়ীতে জয়ের ভেঁপু বাজানোর স্বপ্ন দেখার মতো অবস্থায় ঠিকই চলে যায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সামনে ৩৩০ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেওয়া যে সহজ নয়!

সেটি সম্ভব হয় তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং-বীরত্বে। তাঁদের জোড়া সেঞ্চুরিতে। হ্যাঁ, ভাগ্যের স্পর্শ ছিল দুজনের ইনিংসেই। ব্যক্তিগত ৪৭ রানের সময় তামিমের রিটার্ন ক্যাচ ছাড়েন সাদ নাসিম। ৩৫ রানের সময় মুশফিকের তুলে দেওয়া আরো সহজ ক্যাচ মিডঅনে ফেলেন জুনায়েদ খান। তাতে কি আর ওই দুজনের কৃতিত্ব কমে! সময়ের দাবি মেটানো ইনিংসে বাংলাদেশকে জয়ের পুঁজি ঠিকই এনে দেন যে তাঁরা!

মাশরাফি বিন মর্তুজার বহিষ্কারাদেশে কাল বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। টস জিতে তাঁর ব্যাটিং বেছে নেওয়া ততটা বিস্ময়ের নয়; যতটা তামিমের সঙ্গে সৌম্য সরকারকে ওপেনিংয়ে পাঠানো। তামিমের প্রথম তিন বাউন্ডারি কাভার-পয়েন্ট দিয়ে। শুরুর জড়তা কাটিয়ে সৌম্য ছন্দে ফিরতে খুব সময় নেননি। তবু ১৩.২ ওভারে ৪৮ রানের ওপেনিং জুটিকে সতর্ক না বলে উপায় নেই। রানআউটে সেই জুটি ভাঙার পর বিশ্বকাপের নায়ক মাহমুদ উল্লাহ (৫) যখন বোল্ড হন, দলের রান ২০ ওভারে দুই উইকেটে ৬৭। স্কোরকার্ডের ওই দশা পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়খরা প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছিল ক্রমেই।

কিন্তু মুশফিক ক্রিজে এসে পাল্টে দেন গোটা দৃশ্যপট। তামিমের মতো সহজাত স্ট্রোকমেকার ধুঁকছিল যে ২২ গজে, বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক সেখানে শুরু থেকেই স্বচ্ছন্দ। তাতে রান তোলার তাড়া আর থাকে না ওপেনারের। ৭৫ বলে রয়েসয়ে ফিফটির পর হাত খুলে খেলার স্বাধীনতাটুকু নিতে পারেন তামিম। বাঁ-হাতি স্পিনার হারিস সোহেলকে ছক্কা মারেন পর পর দুই বলে। আর সাঈদ আজমলকে তিন বলের মধ্যে দুই চারে দুই বছর পর আরেকটি ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে পৌঁছান ১১২ বলে। এর পরই তাঁর আরেকটি বিচিত্র উদ্‌যাপন!

তামিমের এক উদ্‌যাপন বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিখ্যাত হয়ে আছে। ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালে ফিফটি করার পর হাত উঁচিয়ে এক-দুই-তিন-চার আঙুল দেখানো। সেই টুর্নামেন্টে তাঁর খেলা ছিল অনিশ্চিত। নানা জল ঘোলার পর দলে ঢুকে টানা চার খেলায় ফিফটি করেন তামিম। এরপর অমন উদ্‌যাপন। কাল সেঞ্চুরির পর আবারও উদ্‌যাপনে আলাদা করে দৃষ্টি কাড়েন এই ওপেনার। দুই হাতের ১০ আঙুল খুলে-বুজে যেমনটা করেন, তাতে যেন ছিল সমালোচকদের মুখ বন্ধ করিয়ে দেওয়ার তৃপ্তি!

মুশফিকের মাঠের বাইরে এসব ব্যাপারে আগ্রহ নেই কোনোকালে। তাঁর শুধু রান করাতেই আনন্দ। কালও সেই রানের নেশায় মিরপুরের সবুজ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন অপূর্ব ব্যাটিং ছবি। সৌন্দর্যে। বীরত্বে। কাভার-একস্ট্রা কাভার দিয়ে খেলেন দুর্দান্ত কিছু স্ট্রোক। সঙ্গে সিগনেচার শট স্লগ সুইপে মিড উইকেটের ওপাড়ে আছড়ে ফেলা ছক্কাও গোটাদুয়েক। শর্ট থার্ড ম্যানে দাঁড়ানো ফিল্ডারের বাঁ ও ডান দিকে গলিয়ে দুটো বাউন্ডারিতে তিন অঙ্কে মুশফিক পৌঁছান যখন, বলের ঘরে মোটে ৬৯। বাংলাদেশের ইতিহাসের তৃতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি।

তামিম-মুশফিকের তৃতীয় উইকেটে ২১.৪ ওভারে তোলা ১৭৮ রান অবশ্য জুটি হিসেবে সবচেয়ে বড়। তাতে ভর করে ৫০ ওভারে ছয় উইকেটে ৩২৯ রানের যে সংগ্রহ গড়ে ওঠে, সেটিও দেশের ইতিহাস-সর্বোচ্চ।

পাকিস্তানের বিপক্ষে নতুন ইতিহাস তৈরি করা জয়ের জন্য এটুকুন কি যথেষ্ট? প্রশ্নটি মিরপুরের সন্ধ্যার বাতাসে উড়ে বেড়ায় কাল অনেকক্ষণ। প্রথমত, গত বছর এশিয়া কাপে এই মাঠে অভিন্ন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ৩২৬ রান করেও হেরে যাওয়া ইতিহাসের কারণে। দ্বিতীয়ত, কাল পাকিস্তানের ১০ ওভারে ৫২ রানের ওপেনিং জুটির সৌজন্যে। আরাফাত সানি এই জুটি ভাঙার পরও উবে যায়নি স্বাগতিকদের স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা। বরং ২৭ ওভারে দুই উইকেটে ১৪৪ রানে পৌঁছে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাকি ২৩ ওভারে ১৮৬ রান করা অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। বিশেষত বাংলাদেশ যখন সমান আট উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ২৩ ওভারে তুলেছিল ২১৩ রান!

কিন্তু সফরকারী দলে তো আর তামিম-মুশফিক নেই। ওপেনিংয়ে নেমে অধিনায়ক আজহার আলী ৭৩ বলে ৭২ করলেই বা কী! পাকিস্তানের জয়ের সম্ভাবনার টিমটিমে প্রদীপটা কখনো পারেনি মশাল হয়ে আলো ছড়াতে। ১১ ওভারে ছয় উইকেট হাতে নিয়ে ১১৪ রানের প্রয়োজনীয়তা হয়তো তাত্ত্বিকভাবে মেটানো সম্ভব। ব্যবহারিকভাবে তা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে ওই ওভারে আরাফাত সানি দুই উইকেট তুলে নিলে। ধুঁকতে ধুঁকতে গিয়ে আড়াই শতে থেমে যায় পাকিস্তানের ইনিংসের চাকা।

আর তাতেই ইতিহাসের চাকা যায় ঘুরে। পরাজয়ের অন্ধগলি পেরিয়ে আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের রাজপথে ছোটা শুরু বাংলাদেশের ক্রিকেটরথের। সিরিজের আবহে নিজেদের ফেভারিট বলে ঘোষণা দেওয়া স্বাগতিকদের নিয়ে এখন আর কেউ নিশ্চয়ই মুখ টিপে হাসছে না। অন্তত পাকিস্তানিরা তো নয়ই!

– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/04/18/211678#sthash.QJg7Jj5W.dpuf

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.