Published On: Sun, May 24th, 2015

মাসিক সচেতনতা বাড়াতে হবে

Share This
Tags

pic-18_225460

নারী স্বাস্থ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য ও স্বাভাবিক অংশ ‘মাসিক’। এখনো আমাদের সমাজে অনেকে এটিকে অস্বাভাবিক ও লজ্জার বিষয় বলে মনে করে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে এখনো এটিকে গোপন বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে অনেক মেয়ে এ সম্পর্কে ভুল ধারণা রাখে এবং মাসিকের সময় যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারে না। এতে করে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে এমনকি মৃত্যুর মুখেও পতিত হয়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের নানাভাবে এই বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে করে মাসিক শুরু হলে সে মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে এবং অসুস্থ না হয়। এ জন্য প্রতিটি পরিবারের অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে।

গতকাল শনিবার দৈনিক কালের কণ্ঠ আয়োজিত ‘আসুন মাসিক নিয়ে কথা বলি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন আলোচকরা। কালের কণ্ঠ, ওয়াটার এইড ও এসএমসির যৌথ আয়োজনে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া কনফারেন্স রুমে। বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, স্বাগত বক্তব্য দেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ওয়াটার এইডের পরিচালক (প্রোগ্রাম ও পলিসি) হাসিন জাহান। আলোচনায় অংশ নেন অতিরিক্ত আইজিপি ফাতেমা বেগম, মাল্টিমোড গ্রুপের পরিচালক নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফওজিয়া হোসেন, জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্য সাথিরা জাকের জেসি, ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চাইল্ড সাইকোলজি বিভাগের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ফায়েজা আহমেদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অ্যাডভোকেসি অফিসার মেহের নিগার, সংগীতশিল্পী আঁখি আলমগীর, অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি, ওয়াটার এইডের পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি স্পেশালিস্ট রুবাইয়া নূসরাত, আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী ও ওমেন্স ওয়ার্ল্ডের পরিচালক ফারনাজ আলম শেরিন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রথম প্রক্রিয়া হলো মাসিক। এই প্রক্রিয়ায় নারী সন্তান গর্ভে ধারণের পর জন্ম দেন। তাই নারীর মর্যাদা অনেক ওপরে। সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো কঠিন কাজটি করার জন্য সৃষ্টিকর্তা এভাবে ধাপে ধাপে নারীকে এগিয়ে নেন। তাই নারীর ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। মাসিক নিয়ে মেয়েদের সচেতন করার জন্য মা-বাবারাই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য মাসিক নিয়ে সচেতনতামূলক কোনো অয়োজন হলে সেখানে অবশ্যই মা-বাবাকে সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখনো মেয়েরা সব বিষয় সহজেই সব খানে বলতে পারে না। তাদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করলে মাসিককালীন বা অন্য সমস্যাগুলো থেকে তারা রেহাই পেতে পারে। তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিসহ সারা দেশের গ্রামের প্রতিনিধিদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে। যাতে মাসিক তাদের কাছে ভয় বা লজ্জার বিষয় না হয়। রাজধানীসহ দেশের সব অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নারীবান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ইতিমধ্যে কাজ করার পরিকল্পনা করছে বলেও জানান তিনি।

স্বাগত বক্তব্যে কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, “একসময় মাসিক নিয়ে কোনো কথাই বলা যেত না। অনেক আগে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ঋতুমতি মেয়েকে নিয়ে লেখা আমার গল্প ছাপা হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিচিত্রায় আমার লেখা ছাপা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক মেয়েই নির্দ্বিধায় মাসিক নিয়ে কথা বলে। কালের কণ্ঠ মনে করে, বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। সাইকেলের দুই চাকার মতো সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের প্রয়োজন। তাই উভয় পক্ষকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে, খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।”

ওয়াটার এইডের পরিচালক (প্রোগ্রাম ও পলিসি) হাসিন জাহান বলেন, ‘মাসিক খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। অথচ এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। মাসিকের কারণে স্কুলগামী ৪০ শতাংশ মেয়ে প্রতি মাসে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এই অনুপস্থিতির কারণে তাদের পড়ালেখা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা দেখা দরকার। এ ছাড়া আমাদের দেশের ৫৮ শতাংশের বেশি মেয়ে অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পুরাতন কাপড় মাসিকের সময় ব্যবহার করে। এতে করে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনকি এর পরিণতিতে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নারীদের সচেতন করতে হবে।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রোকেয়া আক্তার বেগম বলেন, পাঠ্যপুস্তকে মাসিক বিষয়টা থাকলেও সেটা পড়ানো হয় না। তার একমাত্র কারণ হলো বিষয়টা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আলোচনা হয় না। ছাত্রীদের পরিবারের লোকজন চায় না, বিষয়টি নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে শিক্ষকরা খোলামেলা আলোচনা করুক। ক্লাসরুমে যেহেতু আপাতত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তাদের আলাদা করে বসিয়ে হলেও বিষয়গুলো আলোচনা করা দরকার।

অতিরিক্ত আইজিপি ফাতেমা বেগম বলেন, মাসিক নিয়ে সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রথমে পরিবারের অভিভাবককে প্রথমে সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবার, গণমাধ্যম ও বিনোদনের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। একজন নারী যেন সহজে বুঝতে পারে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর একজন অভিভাবক যেন যথাসময়ে তাঁর মেয়ের জন্য যথাযথ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন সে ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সংগীতশিল্পী আঁখি আলমগীর বলেন, ‘মাসিক শুরুর আগেই আমার মা আমাকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছেন, পরবর্তী সময়ে আমি আমার ছোট বোনকে সচেতন করেছি। এর ধারাবাহিকতায় আমি আমার মেয়েদের সচেতন করছি। এ রকম প্রতিটি পরিবারে চালু হলে এ নিয়ে আর কোনো সমস্যা তৈরি হবে না।’ বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্য সাথিয়া জাকের জেসি বলেন, ‘একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে মাসিক চলাকালীন প্র্যাকটিস করাটা কষ্টকর হয়ে যায়। আমি প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে দেখেছি, শিশু পল্লীর একটি মেয়ে ক্রিকেটে অনেক ভালো। তার মাসে দু-তিনবার মাসিক হয়। বিষয়টি সে কাউকে জানায়নি। অনেক পরে যখন জানা গেছে তখনো মেয়েটির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। কেবল সুচিকিৎসার অভাবে আমরা একজন মেধাবী ক্রিকেটার হারিয়েিেছ। অনেকের ক্ষেত্রে এ রকম হয়ে থাকে। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, ‘আমি আমার জায়গা থেকে মাসিক নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য শতভাগ চেষ্টা করি।’ আগামী দিনে এই প্রচেষ্টা আরো বাড়বে বলে জ্যোতিকা জ্যোতি উল্লেখ করেন।

সুত্র – কালের কণ্ঠ

Leave a comment

You must be Logged in to post comment.