রমরমা মাদক কারবার
ঈদকে সামনে রেখে বেচাকেনার ধুম পড়েছিল বিপণিবিতানগুলোতে। নিজের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল সবাই। তবে উৎসবের এই শুভ আয়োজনে বসে ছিল না মাদক ব্যবসায়ীরাও। কারণ ঈদ উপলক্ষে বেড়েছিল মাদকের চাহিদা। তাই রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক তৎপর ছিল মাদক ব্যবসায়ীরা। ঈদ ঘিরে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা ও মদের। প্রতিদিনই রাজধানীতে ইয়াবার চালান নিয়ে এসেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে ইয়াবা গেছে রাজশাহী, যশোর, বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে নজরদারি জোরদার করা হয়েছিল। গঠন করা হয়েছিল বিশেষ টিমও। কয়েকটি চালানও আটক করা হয়েছে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মো. বজলুল রহমান বলেন, ‘ঈদের আগে মাদকব্যবসা বা পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায় বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এ কারণে নজরদারি ও অভিযান জোরদার করা হয়েছিল। ঈদের আগে ও পরে রাজধানীতে নজরদারি করার জন্য দুটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে।’
ডিএনসি সূত্র জানায়, গত প্রায় এক মাসে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৩ হাজার ইয়াবা জব্দ করেছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সব ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯৮টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯৯ জনকে। ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, ঈদের আগে ও পরে রাজধানীর বারসহ মাদক স্পটগুলোতে নিয়ন্ত্রণ রাখতেই গঠন করা হয়েছিল বিশেষ দল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীতে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা সব সময়ই অভিযান পরিচালনা করি। ঈদের সময় মাদক ব্যবসা বাড়তে পারে, এ আশঙ্কা থেকে আগে থেকেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি চালানও উদ্ধার করা গেছে।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে র্যাব। সম্প্রতি কক্সবাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকা থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব। এ সময় ওই ট্রলারের পাঁচ মাঝি-মাল্লাকে আটক করা হয়। পৃথক অভিযানে ১৩ হাজার ৭৭টি ইয়াবা, ৪১ বোতল দেশি-বিদেশি মদ উদ্ধারসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ২১ জুন ফেনীর লালপোল এলাকায় একটি প্রাইভেট কার তল্লাশি করে ছয় লাখ ৬০ হাজার ইয়াবাসহ মাহফুজুর রহমান নামে পুলিশের এক এএসআইকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে কক্সবাজার, ফেনী ও কুমিল্লার একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঢাকায় ইয়াবা সরবরাহ করছিল তারা। এই সিন্ডিকেটে পুলিশের সদস্য ছাড়াও পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে তারা আরো বড় চালান পাচারের পরিকল্পনা করেছিল।
গত ৪ জুলাই রাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে থেকে এক লাখ ৭৮ হাজার ২০০টি ইয়াবাসহ ঈশা খাঁ নামের এক ট্রাকচালককে (মাদক ব্যবসায়ী) গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই রাতে যাত্রাবাড়ীর ফাতেমানাজ পেট্রল পাম্পের সামনে থেকে ২০ হাজার ইয়াবা ও একটি প্রাইভেট কারসহ আরিফুল হক নামের আরো একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
র্যাব-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বলেন, কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় পাচার করছে একটি চক্র। তারা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে যে চালানটি আটক করা হয়, সেটি খালি ট্রাকের চালকের আসনের নিচে প্যাকেটে মোড়ানো অবস্থায় ছিল।
গত ৭ জুলাই উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১১ হাজার ইয়াবাসহ মোহাম্মদ রেজাউল ও আবদুল্লাহ শান্ত নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করের ডিএনসির সদস্যরা। ডিএনসির সহকারী পরিচালক (ঢাকা মেট্রো-উত্তর) মানজুরুল ইসলাম জানান, এই চক্রটি কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে বার্মিজ আচারের মধ্যে করে ইয়াবার চালান এনে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে বিক্রি করে। তারা ঈদ উপলক্ষে আগেও বেশ কয়েকটি চালান এনেছিল।
গত ২৯ জুন রাতে গেণ্ডারিয়ার শরৎগুপ্ত রোডের মেসার্স ‘তানাকা কোম্পানী লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ২১ হাজার ইয়াবা, ১১২ বোতল ফেনসিডিল, ৪৫ ক্যান বিয়ার, একটি রিভলবার, অন্য মাদকদ্রব্যসহ ইয়াসিন আরাফাত নামের একজনকে আটক করে র্যাব। র্যাব-১০-এর অপারেশন অফিসার এএসপি খায়রুল আলম জানান, ফায়দুল ইসলাম মিরাজ নামের এক ব্যক্তি মাদক ব্যবসার জন্য গোপন আস্তানা থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নজরদারি করত। ঈদ সামনে রেখে সেখানে ইয়াবা মজুদ করা হয়। অভিযানে আস্তানাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও ফায়দুল ও তার সহযোগী লিটন, সুমন ও কবিরকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি র্যাব।
সূত্র জানায়, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে এখন মাদকের চালান ঢুকছে রাজধানীতে। গত ১ জুলাই কেরানীগঞ্জের ডাকপাড়া এলাকা থেকে মেহেদী হাসান সুমন ও মমিন নামে দুজনকে পাঁচ মণ গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জানা গেছে, ট্রাকে করে কুমিল্লা থেকে সেখানে নেওয়া হয় চালানটি। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ থেকে বিপুল গাঁজা উদ্ধার করেছে র্যাব।
সূত্র জানায়, গাড়িতে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা সরবরাহের পাশাপাশি এখন ট্রেনেও আসছে চালান। সর্বশেষ কমলাপুরে ১৬ বোতল ফেনসিডিলসহ রহিদুল ইসলাম নামের একজনকে আটক করেছে ঢাকা রেলওয়ে থানার পুলিশ।
থানার ওসি আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদে মাদক বাণিজ্য বেড়ে যায় বলে আমরা সতর্ক আছি। রমজানে অর্ধশতাধিক মাদকের মামলা হয়েছে। আমরা ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। স্টেশনে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।’
সুত্র – কালের কণ্ঠ