জলকন্যা ওয়ার্দা
সাগরের অপার সৌন্দর্য। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মন ভালো হয়ে যায় মুহূর্তেই। তবে অধিকাংশ মানুষই এর উপরিভাগটা দেখেন। তবে সমুদ্রের ভেতরের রূপ আর রহস্যময় জগত সম্পর্কে কিছু সৌখিন এবং দুঃসাহসী মানুষ নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কম হলেও দুঃসাহসী স্কুবা ডাইভিং করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি সায়িদা ফাতমী ওয়ার্দা।
“সাগরতলে ঘুরে বেড়ানো আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরপর তিন দিনের বিশেষ ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছি। সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সুযোগ পাই সমুদ্রে নামার। শীতকালটা সমুদ্রের তলদেশে নামার জন্য বিশেষ উপযোগী। ২০০৯ সালে প্রথম আমি এ স্বপ্ন পূরণ করি” নিজের অনুভূতিগুলো এভাবেই বলা শুরু করলেন ফাতমী ওয়ার্দা।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “পানির নিচে এক অদ্ভুত জগৎ। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আমি। আমার চারদিকে ছোট ছোট মাছ। কখনো সামনে, কখনো পেছন পেছন দল বেঁধে সাঁতার কাটছিল। একসময় সব মাছ আমার চারদিক ঘিরে ধরেছিল চাদরের মতো। আমি যেমন এদের অবাক হয়ে দেখছিলাম, ওরাও আমাকে দেখছিল।”
পানির নিচের সেই জগত সম্পর্কে সায়িদা ফাতমীর ওয়ার্দার কণ্ঠস্বরের রোমাঞ্চটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল।
মনে হতে পারে চট্টগ্রামের মেয়ে সায়িদা ফাতমী ওয়ার্দা ঘুমের ঘোরে দেখা কোনো স্বপ্নের বর্ণনা দিচ্ছেন। চাকরিজীবী এ মেয়েটি হয়তো টেলিভিশনের সামনে বসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকোভারি চ্যানেল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কোনো স্বপ্ন নয়, লিবিয়ায় জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশি বংশম্ভূত সায়িদা ফাতমী ওয়ার্দা কথাগুলো বলছিলেন তার অভিজ্ঞতা থেকে…
স্কুবা ডাইভিং কখনো শখ, কখনো নেশা, কখনো বা পেশা। জলের অতল ঘুরে দেখার হেতু যা-ই হোক, কাজটা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর! সমাজের অন্য চোখ, সুযোগের অভাব কিংবা কাজের চাপের কথা ভেবে অনেক মেয়েই হয়তো এ ধরনের রোমাঞ্চ নিজ চোখে দেখার স্বপ্ন অলক্ষ্যে বাদ দিয়েছেন। কিন্তু সায়িদা ফাতমী ওয়ার্দা ইতোমধ্যেই সাগর তলে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছেন। প্রায় প্রতিবছরই টুপ করে ঘুরে আসছেন জল-অতলের অপার সৌন্দর্যে। অন্য ডুবুরিদের সাথে দল বেঁধে সেন্ট মার্টিনে সাগরতলের ময়লা অপসারণের কাজও করছেন ওয়ার্দা।
তিনি বলেন, “আমাদের দলে আমি ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। খুব খুশি হব, যদি আগ্রহ নিয়ে আরও অনেকে যোগ দেয়। শুধু নিজের আশপাশটা জানলেই তো হবে না। আকাশে It is highly addictive and leads to tolerance sometimes after one use, so increasing doses of cocaine are needed to achieve a high. কী হচ্ছে, পানির নিচে কী হচ্ছে-সবই দেখতে হবে।”
ওশানিক স্কুবা ডাইভিং সেন্টারের প্রশিক্ষক এস এম আতিকুর রহমান বলেন, “অ্যাডভেঞ্চারের মজা তো আছেই। তাছাড়া স্কুবা ডাইভিং শিখে নিলে দেশে-বিদেশে কাজ করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। সমুদ্র-সম্পর্কিত পড়ালেখা, আলোকচিত্রের কাজেও স্কুবা ডাইভিং বেশ উপকারী।”
তিনি বলেন, “আমাদের এখন দরকার নিজেদের আত্মবিশ্বাসে ঘুরে দাঁড়াবার, “হ্যাঁ, চাইলে আমিও পারি”।”
“অন্যদের মধ্যে থেকে কিছু আলাদা করার ইচ্ছে ছিল। দেশের বাইরে আমার জন্ম দেশের আসার পর দেখতে পেলাম দেশের বাইরে মেয়েরা যা করতে পাচ্ছে তা এখানে করতে পাচ্ছে না। দেশের বাইরে ছেলেমেয়েরা একসাথে কাজ করে কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েরা ঘর থেকেই বের হয় না।”
ওয়ার্দা আরো বলেন, “আমার কাছে নতুন নতুন কিছু করা যেমন, ইনফরমেটিভ কিছু করার ইচ্ছে।ছোটবেলা থেকে ন্যাশনালজি ওগ্রাফী ও ডিসকভারি চ্যানেল দেখতাম।যা আমাকে খুবই আকর্ষণ করতো। দেশে ডাইভিং করার মতো সুযোগ আছে তা আমার জানা ছিল না। ভেবেছিলাম দেশের বাইরে গিয়ে ডাইভ করবো।”
তিনি বলেন, “ডাইভার আতিক ভাইয়ের কথা নেট থেকে জানতে পেরেছিলাম। এরপর প্রায় দুই বছর উনার কাছ থেকে ডাইভিং এবং সাগর তলের নানান অজানা বিষয়ে আলোচনা করেছি। উনি চেক করছিলেন যে আমি মানসিকভাবে কতটা শক্ত। কারণ একজন নারী হওয়াতে হয়তো উনার মধ্যে দ্বিধা কাজ করছিল। আমি পারবো কিনা।”
ওয়ার্দা বলেন, “ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য জেনে আমি আতিক ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতাম। কিভাবে ডাইভ করতে হবে, পানির নীচে চলাচল করতে হয় ও কিভাবে অক্সিজেন কাজ করে ইত্যাদি। এরপর আমি সাতারের ওপরও একটা ট্রেনিং করেছি।”
তিনি বলেন, “২০০৯ সালে প্রথম সেন্টমার্টিনের সাগর তলে ডাইভ করি। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ৭ বার স্কুবা ডাইভিং করেছি।”
প্রথমবার সেন্টমার্টিন উদ্দেশ্য যাত্রা করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওয়ার্দা বলেন, “রাত ২টায় চট্টগ্রাম থেকে একটি বাসে আমি টেকনাফের উদ্দেশ্য একাই যাত্রা করি। সেখান থেকে জাহাজে করে সোজা সেন্টমার্টিনে পৌছায়।”
এক জন নারী হিসেবে একা এতো রাতে যেতে ভয় লেগেছে কিনা জানতে চাইলে প্রত্যয়ী উত্তরে তিনি বলেন, “নাহ.. একটুও ভয় লাগেনি আমার। কারণ আমি এতো রোমাঞ্চিত ছিলাম শুধু ভাবছিলাম কখন আমি পৌছাবো আর সাগরে ডাইভিং করবো।”
জীবনের প্রথম ডাইভিং করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ওয়ার্দা। তিনি বলেন, “ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে সব নিয়ম-কানুন সেরে। নৌকা থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর যতই নীচের দিকে যাচ্ছিলাম। আমি ততই রোমাঞ্চিত ছিলাম। এক পর্যায়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করি। ঠিক যখন পানির ১৫ থেকে ২০ ফুট নীচে পৌছে চোখ খুলে দেখি সবকিছুই কেমন যেন বড় বড় লাগছে। এরপর ধীরে ধীরে যখন মুভ করতে থাকি তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন ন্যাশানল জিওগ্রাফি দেখছি। যেবারই আমি প্রথম সাগরের নীচে কোরাল, সি-উইড ওও বিভিন্ন ধরণের রঙ্গিণ সামুদ্রিক মাছ দেখেছি।”
তিনি বলেন, “প্রথমবার আমি ২৭ মিনিট সাগর তলে বিচরণ করেছি।”
পরিবারের সকলে ডাইভিংয়ে সহযোগিতা করেছে জানিয়ে ওয়ার্দা বলেন, “আমার বাবা-মা ও পরিবারের সকলে বুঝতে পেরেছে আমার মধ্যে একটা জেদ কাজ করছে। কিন্তু তারা যখন দেখলো আমি আন্ডারওয়াটারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছি। তারা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। তাই আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে আমার আম্মু বলতো, সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করবে। যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তার এ কথাতেই আমার সাহস সঞ্চার করেছিল।”
বাংলাদেশের মেয়েরা স্কুবা ডাইভিংয়ে আগ্রহী না জানিয়ে ওয়ার্দা বলেন, “আমি আমার অনেক মেয়ে বন্ধুকে এ সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইনি। আমি আশা করি আমার মত সকল বাঙ্গালী মেয়েকে এগিয়ে আসবেন। কারণ সাহস মাধ্যমেই ভয়কে দূর করা যায় বলে আমি মনে করি।”
ওয়ার্দা ডাইভার হিসেবে আরো এগিয়ে যেতে চান। তিনি মনে করেন, “আমরা মেয়েরা চাইলে সব করতে পারি এবং চাইলে বাঙালি মেয়েরাও পারে। বাঙালি মেয়েরাও যে পিছিয়ে নেই তা তিনি ডাইভের মতো একটি দুঃসাহসিক কাজ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশের মেয়েরা চাইলে যেকোন কিছু জয় করার ক্ষমতা রাখি।”
আশা ব্যক্ত করে তিনি আরো বলেন, “বর্তমান সময়ে যখন রাজনৈতিক ও সামাজিক শিকলে মেয়েদেরকে বন্দি করার সঙ্কীর্ণ ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে তখন এই সাহসী সাফল্য নিঃসন্দেহে আমাদের বাঙালি মেয়েদেরকে আরো এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেবে। নিজেও মনে প্রাণে চাই, বাঙালি মেয়েরা সাহসী হয়ে এগিয়ে যাক, বিশ্ব জয় করুক।”
বাঙ্গালী নারী হিসেবে শুধু সায়িদা ফাতমীই নন বাংলাদেশের আরেক নারী মুসলিমা আক্তার। এখন তিনি স্কুবা ডাইভার। অস্ট্রেলিয়ায় ডুবুরিদের প্রশিক্ষণও দেন তিনি। মুসলিমা এখন লাইসেন্সধারী ‘মাস্টার স্কুবা ডাইভার ট্রেইনার’ হিসেবে কর্মরত আছেন অষ্ট্রেলিয়ায়।